মানসসুন্দরী
আজ কোনো কাজ নয়— সব ফেলে দিয়ে
ছন্দ বন্ধ গ্রন্থ গীত— এসো তুমি প্রিয়ে,
আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার
কবিতা, কল্পনালতা। শুধু একবার
কাছে বোসো। আজ শুধু কূজন গুঞ্জন
তোমাতে আমাতে; শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এই সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা—
যতক্ষণ অন্তরের শিরা-উপশিরা
লাবণ্যপ্রবাহভরে ভরি নাহি উঠে,
যতক্ষণে মহানন্দে নাহি যায় টুটে
চেতনাবেদনাবন্ধ, ভুলে যাই সব—
কী আশা মেটে নি প্রাণে, কী সংগীতরব
গিয়েছে নীরব হয়ে, কী আনন্দসুধা
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি,
এই মধুরতা, দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দুঃখ দৈন্য অতৃপ্তির ‘পর
করুণকোমল আভা গভীর সুন্দর।
বীণা ফেলে দিয়ে এসো, মানসসুন্দরী—
দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও— মৃণাল-পরশে
রোমা’ অঙ্কুরি উঠে মর্মান্ত হরষে,
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধ তনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত-প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে।
অর্ধেক অঞ্চল পাতি বসাও যতনে
পার্শ্বে তব; সমধুর প্রিয়সম্বোধনে
ডাকো মোরে, বলো, প্রিয়, বলো, ‘প্রিয়তম’—
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সংগোপনে বলে যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা। অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক, হাসি স্তরে স্তরে
সরস সুন্দর; নবষ্ফুট পুষ্প-সম
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি তুলে ধোরো; আনন্দ-আভায়
বড়ো বড়ো দুটি চক্ষু পল্লবপ্রচ্ছায়
রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত নির্ভরে। যদি চোখে জল আসে
কাঁদিব দুজনে; যদি ললিত কপোলে
মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি মোর কোলে,
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়ো নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি।
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে
বলে যেয়ো কথা, তরল আনন্দভরে
নির্ঝরের মতো, অর্ধেক রজনী ধরি
কত-না কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী—
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি। যদি গান
ভালো লাগে, গেয়ো গান। যদি মুগ্ধপ্রাণ
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই রব প্রিয়া।
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের পাতার মতো; সন্ধ্যাতারা ধীরে
সন্তর্পণে করে পদার্পণ, নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে; যামিনী শয়ন তার
দেয় বিছাইয়া, একখানি অন্ধকার
অনন্ত ভুবনে। দোঁহে মোরা রব চাহি
অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি,
শুধু মোর করে তব করতলখানি,
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী,
অসীম নির্জনে; বিষণ্ন বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি—
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয় মগন
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি
বক্ষ দুরুদুরু, দুই প্রাণে আছে ফুটি
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা।
আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্য-বিলাসে। অয়ি নিরভিমানিনী,
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্যের শশী,
মনে আছে কবে কোন্ ফুল্ল যূথীবনে,
বহু বাল্যকালে, দেখা হত দুই জনে
আধো-চেনাশোনা? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে
সখী, আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকামূর্তি, শুভ্রবস্ত্র পরি
উষার কিরণধারে সদ্য স্নান করি
বিকচ কুসুম-সম ফুল্ল মুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি
উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশব-কর্তব্য হতে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি,
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা-কারা হতে; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে যেতে নির্জনেতে রহস্যভবনে;
জনশূন্য গৃহছাদে আকাশের তলে
কী করিতে খেলা, কী বিচিত্র কথা বলে
ভুলাতে আমারে, স্বপ্ন-সম চমৎকার
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জান তার।
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে
সোনার বলয়, দুটি কপোলের ‘পরে
খেলিত অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত আলোক, নির্মল নির্ঝর-স্রোতে
চূর্ণরশ্মি-সম। দোঁহে দোঁহা ভালো করে
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধুলা ছুটাছুটি দুজনে সতত—
কথাবার্তা বেশবাস বিথান বিতত।
তার পরে একদিন— কী জানি সে কবে—
জীবনের বনে যৌবনবসন্তে যবে
প্রথম মলয়বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস,
মুকুলিয়া উঠিতেছে শত নব আশ,
সহসা চকিত হয়ে আপন সংগীতে
চমকিয়া হেরিলাম— খেলা-ক্ষেত্র হতে
কখন অন্তরলক্ষ্মী এসেছ অন্তরে,
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসি আছ মহিষীর মতো। কে তোমারে
এনেছিল বরণ করিয়া। পুরদ্বারে
কে দিয়াছে হুলুধ্বনি! ভরিয়া অঞ্চল
কে করেছে বরিষন নবপুষ্পদল
তোমার আনম্র শিরে আনন্দে আদরে!
সুন্দর সাহানা-রাগে বংশীর সুস্বরে
কী উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যেদিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্ল পথে
লজ্জামুকুলিত মুখে রক্তিম অম্বরে
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চিরদিনতরে
আমার অন্তর-গৃহে— যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখ দুঃখ লয়ে,
যেখানে আমার যত লজ্জা আশা ভয়
সদা কম্পমান, পরশ নাহিকো সয়
এত সুকুমার! ছিলে খেলার সঙ্গিনী
এখন হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী,
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমূলক হাসি-অশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই,
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধ দৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছ নীলাম্বর-সম; হাসিখানি স্থির
অশ্রুশিশিরেতে ধৌত; পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত বল্লরীর মতো; প্রীতি স্নেহ
গভীর সংগীততানে উঠিছে ধ্বনিয়া
স্বর্ণবীণাতন্ত্রী হতে রনিয়া রনিয়া
অনন্ত বেদনা বহি। সে অবধি প্রিয়ে,
রয়েছি বিস্মিত হয়ে—তোমারে চাহিয়ে
কোথাও না পাই অন্ত। কোন্ বিশ্বপার
আছে তব জন্মভূমি। সংগীত তোমার
কত দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে
আমারে করিবে বন্দী গানের পুলকে
বিমুগ্ধ কুরঙ্গসম। এই যে বেদনা,
এর কোনো ভাষা আছে? এই যে বাসনা,
এর কোনো তৃপ্তি আছে? এই যে উদার
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী, দশ দিশি
অস্ফুট কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি
কী কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে,
এর কোনো কূল আছে? সৌন্দর্য পাথারে
যে বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী
সে বাতাসে, কত বার মনে শঙ্কা করি,
ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল;
অভয় আশ্বাসভরা নয়ন বিশাল
হেরিয়া ভরসা পাই বিশ্বাস বিপুল
জাগে মনে— আছে এক মহা উপকূল
এই সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে
মোদের দোঁহের গৃহ।
হাসিতেছ ধীরে
চাহি মোর মুখে, ওগো রহস্যমধুরা!
কী বলিতে চাহ মোরে প্রণয়বিধুরা
সীমান্তিনী মোর, কী কথা বুঝাতে চাও।
কিছু বলে কাজ নাই— শুধু ঢেকে দাও
আমার সর্বাঙ্গ মন তোমার অঞ্চলে,
সম্পূর্ণ হরণ করি লহ গো সবলে
আমার আমারে; নগ্ন বক্ষে বক্ষ দিয়া
অন্তর রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া।
তোমার হৃদয়কম্প অঙ্গুলির মতো
আমার হৃদয়তন্ত্রী করিবে প্রহত,
সংগীত-তরঙ্গধ্বনি উঠিবে গুঞ্জরি
সমস্ত জীবন ব্যাপী থরথর করি।
নাই বা বুঝিনু কিছু, নাই বা বলিনু,
নাই বা গাঁথিনু গান, নাই বা চলিনু
ছন্দোবদ্ধ পথে, সলজ্জ হৃদয়খানি
টানিয়া বাহিরে। শুধু ভুলে গিয়ে বাণী
কাঁপিব সংগীতভরে, নক্ষত্রের প্রায়
শিহরি জ্বলিব শুধু কম্পিত শিখায়,
শুধু তরঙ্গের মতো ভাঙিয়া পড়িব
তোমার তরঙ্গ-পানে, বাঁচিব মরিব
শুধু, আর কিছু করিব না। দাও সেই
প্রকাণ্ড প্রবাহ, যাহে এক মুহূর্তেই
জীবন করিয়া পূর্ণ, কথা না বলিয়া
উন্মত্ত হইয়া যাই উদ্দাম চলিয়া।
মানসীরূপিণী ওগো, বাসনাবাসিনী,
আলোকবসনা ওগো, নীরবভাষিণী,
পরজন্মে তুমি কে গো মূর্তিমতী হয়ে
জন্মিবে মানব-গৃহে নারীরূপ লয়ে
অনিন্দ্যসুন্দরী? এখন ভাসিছ তুমি
অনন্তের মাঝে; স্বর্গ হতে মর্তভূমি
করিছ বিহার; সন্ধ্যার কনকবর্ণে
রাঙিছ অঞ্চল; উষার গলিত স্বর্ণে
গড়িছ মেখলা; পূর্ণ তটিনীর জলে
করিছ বিস্তার, তলতল ছলছলে
ললিত যৌবনখানি, বসন্তবাতাসে,
চঞ্চল বাসনাব্যথা সুগন্ধ নিশ্বাসে
করিছ প্রকাশ; নিষুপ্ত পূর্ণিমা রাতে
নির্জন গগনে, একাকিনী ক্লান্ত হাতে
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহ-শয়ন;
শরৎ-প্রত্যুষে উঠি করিছ চয়ন
শেফালি, গাঁথিতে মালা, ভুলে গিয়ে শেষে,
তরুতলে ফেলে দিয়ে, আলুলিত কেশে
গভীর অরণ্য-ছায়ে উদাসিনী হয়ে
বসে থাক; ঝিকিমিকি আলোছায়া লয়ে
কম্পিত অঙ্গুলি দিয়ে বিকালবেলায়
বসন বয়ন কর বকুলতলায়;
অবসন্ন দিবালোকে কোথা হতে ধীরে
ঘনপল্লবিত কুঞ্জে সরোবর-তীরে
করুণ কপোতকণ্ঠে গাও মুলতান;
কখন অজ্ঞাতে আসি ছুঁয়ে যাও প্রাণ
সকৌতুকে; করি দাও হৃদয় বিকল,
অঞ্চল ধরিতে গেলে পালাও চঞ্চল
কলকণ্ঠে হাসি’, অসীম আকাঙ্ক্ষারাশি
জাগাইয়া প্রাণে, দ্রুতপদে উপহাসি’
মিলাইয়া যাও নভোনীলিমার মাঝে।
কখনো মগন হয়ে আছি যবে কাজে
স্খলিতবসন তব শুভ্র রূপখানি
নগ্ন বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি
চকিতে চমকি চলি যায়। জানালায়
একেলা বসিয়া যবে আঁধার সন্ধ্যায়,
মুখে হাত দিয়ে, মাতৃহীন বালকের
মতো বহুক্ষণ কাঁদি স্নেহ-আলোকের
তরে— ইচ্ছা করি, নিশার আঁধারস্রোতে
মুছে ফেলে দিয়ে যায় সৃষ্টিপট হতে
এই ক্ষীণ অর্থহীন অস্তিত্বের রেখা,
তখন করুণাময়ী দাও তুমি দেখা
তারকা-আলোক-জ্বালা স্তব্ধ রজনীর
প্রান্ত হতে নিঃশব্দে আসিয়া; অশ্রুনীর
অঞ্চলে মুছায়ে দাও; চাও মুখপানে
স্নেহময় প্রশ্নভরা করুণ নয়ানে;
নয়ন চুম্বন কর, স্নিগ্ধ হস্তখানি
ললাটে বুলায়ে দাও; না কহিয়া বাণী,
সান্ত্বনা ভরিয়া প্রাণে, কবিরে তোমার
ঘুম পাড়াইয়া দিয়া কখন আবার
চলে যাও নিঃশব্দ চরণে।
সেই তুমি
মূর্তিতে দিবে কি ধরা? এই মর্তভূমি
পরশ করিবে রাঙা চরণের তলে?
অন্তরে বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে
সর্ব ঠাঁই হতে সর্বময়ী আপনারে
করিয়া হরণ, ধরণীর একধারে
ধরিবে কি একখানি মধুর মুরতি?
নদী হতে লতা হতে আনি তব গতি
অঙ্গে অঙ্গে নানা ভঙ্গে দিবে হিল্লোলিয়া—
বাহুতে বাঁকিয়া পড়ি, গ্রীবায় হেলিয়া
ভাবের বিকাশভরে? কী নীল বসন
পরিবে সুন্দরী তুমি? কেমন কঙ্কণ
ধরিবে দুখানি হাতে? কবরী কেমনে
বাঁধিবে, নিপুণ বেণী বিনায়ে যতনে?
কচি কেশগুলি পড়ি শুভ্র গ্রীবা-’পরে
শিরীষকুসুম-সম সমীরণভরে
কাঁপিবে কেমন? শ্রাবণে দিগন্তপারে
যে গভীর স্নিগ্ধ দৃষ্টি ঘন মেঘভারে
দেখা দেয় নব নীল অতি সুকুমার,
সে দৃষ্টি না জানি ধরে কেমন আকার
নারীচক্ষে! কী সঘন পল্লবের ছায়,
কী সুদীর্ঘ কী নিবিড় তিমির-আভায়
মুগ্ধ অন্তরের মাঝে ঘনাইয়া আনে
সুখবিভাবরী! অধর কী সুধাদানে
রহিবে উন্মুখ, পরিপূর্ণ বাণীভরে
নিশ্চল নীরব! লাবণ্যের থরে থরে
অঙ্গখানি কী করিয়া মুকুলি বিকশি
অনিবার সৌন্দর্যেতে উঠিবে উচ্ছ্বসি
নিঃসহ যৌবনে?
জানি, আমি জানি সখী,
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখোচোখি
সেই পরজন্ম-পথে, দাঁড়াব থমকি;
নিদ্রিত অতীত কাঁপি উঠিবে চমকি
লভিয়া চেতনা। জানি মনে হবে মম,
চিরজীবনের মোর ধ্রুবতারা-সম
চিরপরিচয়ভরা ওই কালো চোখ।
আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক,
আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা,
আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা
এই মুখখানি। তুমিও কি মনে মনে
চিনিবে আমারে? আমাদের দুই জনে
হবে কি মিলন? দুটি বাহু দিয়ে, বালা,
কখনো কি এই কণ্ঠে পরাইবে মালা
বসন্তের ফুলে? কখনো কি বক্ষ ভরি
নিবিড় বন্ধনে, তোমারে হৃদয়েশ্বরী,
পারিব বাঁধিতে? পরশে পরশে দোঁহে
করি বিনিময় মরিব মধুর মোহে
দেহের দুয়ারে? জীবনের প্রতিদিন
তোমার আলোক পাবে বিচ্ছেদবিহীন,
জীবনের প্রতি রাত্রি হবে সুমধুর
মাধুর্যে তোমার, বাজিবে তোমার সুর
সর্ব দেহে মনে? জীবনের প্রতি সুখে
পড়িবে তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে
পড়িবে তোমার অশ্রুজল। প্রতি কাজে
রবে তব শুভহস্ত দুটি, গৃহ-মাঝে
জাগায়ে রাখিবে সদা সুমঙ্গল—জ্যোতি।
এ কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি,
কল্পনার ছল? কার এত দিব্যজ্ঞান,
কে বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ—
পূর্বজন্মে নারীরূপে ছিলে কি না তুমি
আমারি জীবন-বনে সৌন্দর্যে কুসুমি,
প্রণয়ে বিকশি। মিলনে আছিলে বাঁধা
শুধু এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা
আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে,
তোমারে দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে।
ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধবাষ্প তার
পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারি ধার।
গৃহের বনিতা ছিলে, টুটিয়া আলয়
বিশ্বের কবিতারূপে হয়েছ উদয়—
তবু কোন্ মায়া-ডোরে চিরসোহাগিনী,
হৃদয়ে দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী
জাগায়ে তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়।
তাই তো এখনো মনে আশা জেগে রয়
আবার তোমারে পাব পরশবন্ধনে।
এমনি সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে
জ্বলিছে নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি,
কখনো বা ভাবময়, কখনো মুরতি।
রজনী গভীর হল, দীপ নিবে আসে;
পদ্মার সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে
কখন যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণরেখা
মিলাইয়া গেছে; সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা
তিমিরগগনে; শেষ ঘট পূর্ণ ক’রে
কখন বালিকা-বধূ চলে গেছে ঘরে;
হেরি কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি, একাদশী তিথি,
দীর্ঘ পথ, শূন্য ক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি
গ্রামে গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী;
কখন গিয়েছে থেমে কলরবরাশি
মাঠপারে কৃষিপল্লী হতে; নদীতীরে
বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটিরে
কখন জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যাদীপখানি,
কখন নিভিয়া গেছে— কিছুই না জানি।
কী কথা বলিতেছিনু, কী জানি, প্রেয়সী,
অর্ধ-অচেতনভাবে মনোমাঝে পশি
স্বপ্নমুগ্ধ-মতো। কেহ শুনেছিলে সে কি,
কিছু বুঝেছিলে প্রিয়ে, কোথাও আছে কি
কোনো অর্থ তার? সব কথা গেছি ভুলে,
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু-পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গম্ভীর নিস্বনে।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহো টানি— শোয়াও যতনে
মরণসুস্নিগ্ধ ও শুভ্র বিস্মৃতিশয়নে।
মায়াবাদ
হা
রে নিরানন্দ
দেশ , পরি
জীর্ণ জরা
,
বহি বি জ্ঞ তার বোঝা , ভাবিতেছ মনে
ঈশ্বরের প্রবঞ্চনা পড়িয়াছে ধরা
সুচতুর সূক্ষ্মদৃষ্টি তোমার নয়নে!
লয়ে কুশাঙ্কুর বুদ্ধি শাণিত প্রখরা
কর্মহীন রাত্রিদিন বসি গৃহকোণে
মিথ্যা ব ‘ লে জানিয়াছ বিশ্ববসুন্ধরা
গ্রহতারাময় সৃষ্টি অনন্ত গগনে ।
যুগযুগান্তর ধ ‘ রে পশু পক্ষী প্রাণী
অচল নির্ভয়ে হেথা নিতেছে নিশ্বাস
বিধাতার জগতেরে মাতৃক্রোড় মানি ;
তুমি বৃদ্ধ কিছুরেই কর না বিশ্বাস!
লক্ষ কোটি জীব লয়ে এ বিশ্বের মেলা
তুমি জানিতেছ মনে , সব ছেলেখেলা ।
বহি বি জ্ঞ তার বোঝা , ভাবিতেছ মনে
ঈশ্বরের প্রবঞ্চনা পড়িয়াছে ধরা
সুচতুর সূক্ষ্মদৃষ্টি তোমার নয়নে!
লয়ে কুশাঙ্কুর বুদ্ধি শাণিত প্রখরা
কর্মহীন রাত্রিদিন বসি গৃহকোণে
মিথ্যা ব ‘ লে জানিয়াছ বিশ্ববসুন্ধরা
গ্রহতারাময় সৃষ্টি অনন্ত গগনে ।
যুগযুগান্তর ধ ‘ রে পশু পক্ষী প্রাণী
অচল নির্ভয়ে হেথা নিতেছে নিশ্বাস
বিধাতার জগতেরে মাতৃক্রোড় মানি ;
তুমি বৃদ্ধ কিছুরেই কর না বিশ্বাস!
লক্ষ কোটি জীব লয়ে এ বিশ্বের মেলা
তুমি জানিতেছ মনে , সব ছেলেখেলা ।
মুক্তি
চক্ষু
কর্ণ বুদ্ধি
মন সব
রুদ্ধ করি
,
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে ,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে ,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি ‘ ,
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে ।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক ,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক ।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে ?
বিমুখ হইয়া সর্ব জগতের পানে ,
শুদ্ধ আপনার ক্ষুদ্র আত্মাটিরে ধরি
মুক্তি-আশে সন্তরিব কোথায় কে জানে!
পার্শ্ব দিয়ে ভেসে যাবে বিশ্বমহাতরী
অম্বর আকুল করি যাত্রীদের গানে ,
শুভ্র কিরণের পালে দশ দিক ভরি ‘ ,
বিচিত্র সৌন্দর্যে পূর্ণ অসংখ্য পরানে ।
ধীরে ধীরে চলে যাবে দূর হতে দূরে
অখিল ক্রন্দন-হাসি আঁধার-আলোক ,
বহে যাবে শূন্যপথে সকরুণ সুরে
অনন্ত-জগৎ-ভরা যত দুঃখশোক ।
বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা বসে রব মুক্তি-সমাধিতে ?
যেতে নাহি দিব
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি ; বেলা দ্বিপ্রহর ;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর ।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে ; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে ; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম —
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম ।
গিয়েছে আশ্বিন — পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে । ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে ,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে ।
ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে ,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার ,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে ; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে ; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা । আমি বলি , ‘ এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে । '
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন । ' কী জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে ?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান ;
ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল ;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল ;
আমসত্ত্ব আমচুর ; সের দুই দুধ —
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে ,
মাথা খাও , ভুলিয়ো না , খেয়ো মনে করে । '
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয় ।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় ।
তাকানু ঘড়ির পানে , তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে ; কহিলাম ধীরে ,
‘ তবে আসি ' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু- ' পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন ।
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের । এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন ,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে ; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে ; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার । এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে ,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন । শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল । কহিনু যখন
‘ মা গো , আসি ' সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন
ম্লান মুখে , ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় । '
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় ,
ধরিল না বাহু মোর , রুধিল না দ্বার ,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ।
তবুও সময় হল শেষ , তবু হায়
যেতে দিতে হল ।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে ,
কে রে তুই , কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা , এত স্পর্ধাভরে —
‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ? চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনী , সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ ।
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
এ জগতে , শুধু বলে রাখা ' যেতে দিতে
ইচ্ছা নাহি ' । হেন কথা কে পারে বলিতে
‘ যেতে নাহি দিব ' ! শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববাণী , সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে ,
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভরে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন ,
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন ।
চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে । তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে । বহে খরবেগ
শরতের ভরা গঙ্গা । শুভ্র খণ্ডমেঘ
মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে । দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস ।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ ,
সমস্ত পৃথিবী । চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে ,
‘ যেতে নাহি দিব । যেতে নাহি দিব । ' সবে
কহে ‘ যেতে নাহি দিব ' । তৃণ ক্ষুদ্র অতি
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে ‘ যেতে নাহি দিব ' ।
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব ,
আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
কহিতেছে শত বার ' যেতে দিব না রে ' ।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা , সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন — ‘ যেতে নাহি দিব ' । হায় ,
তবু যেতে দিতে হয় , তবু চলে যায় ।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে ।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
‘ দিব না দিব না যেতে ' ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে ।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
‘ দিব না দিব না যেতে ' — নাহি শুনে কেউ
নাহি কোনো সাড়া ।
চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে ; শিশুর মতন
বিশ্বের অবোধ বাণী । চিরকাল ধরে
যাহা পায় তাই সে হারায় , তবু তো রে
শিথিল হল না মুষ্টি , তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
‘ যেতে নাহি দিব ' । ম্লান মুখ , অশ্রু-আঁখি ,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব ,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব ,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
‘ যেতে নাহি দিব ' । যত বার পরাজয়
তত বার কহে , ‘ আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ।
আমার আকাঙ্ক্ষা-সম এমন আকুল ,
এমন সকল-বাড়া , এমন অকূল ,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর! '
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
‘ যেতে নাহি দিব ' । তখনি দেখিতে পায় ,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন ;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন ,
ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির । তবু প্রেম বলে ,
‘ সত্যভঙ্গ হবে না বিধির । আমি তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকার-লিপি । ' — তাই স্ফীত বুকে
সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
বলে , ‘ মৃত্যু তুমি নাই । — হেন গর্বকথা!
মৃত্যু হাসে বসি । মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার , বিষণ্ন নয়ন- ' পরে
অশ্রুবাষ্প-সম , ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
চির-কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে —
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে ,
স্তব্ধ সকাতর । চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া —
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে মায়া ।
তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
এত ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র লয়ে ; বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে ।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে ; শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী ।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।
রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে
রূপকথা
১
প্রভাতে
রাজার ছেলে যেত পাঠশালায়,
রাজার মেয়ে যেত তথা।
দুজনে দেখা হত পথের মাঝে,
কে জানে কবেকার কথা।
রাজার মেয়ে দূরে সরে যেত,
চুলের ফুল তার পড়ে যেত,
রাজার ছেলে এসে তুলে দিত
ফুলের সাথে বনলতা।
রাজার ছেলে যেত পাঠশালায়,
রাজার মেয়ে যেত তথা।
পথের দুই পাশে ফুটেছে ফুল,
পাখিরা গান গাহে গাছে।
রাজার মেয়ে আগে এগিয়ে চলে,
রাজার ছেলে যায় পাছে।
২
মধ্যাহ্নে
উপরে বসে পড়ে রাজার মেয়ে,
রাজার ছেলে নীচে বসে।
পুঁথি খুলিয়া শেখে কত কী ভাষা,
খড়ি পাতিয়া আঁক কষে।
রাজার মেয়ে পড়া যায় ভুলে,
পুঁথিটি হাত হতে পড়ে খুলে,
রাজার ছেলে এসে দেয় তুলে,
আবার পড়ে যায় খসে।
উপরে বসে পড়ে রাজার মেয়ে,
রাজার ছেলে নীচে বসে।
দুপুরে খরতাপ, বকুলশাখে
কোকিল কুহু কুহরিছে।
রাজার ছেলে চায় উপর-পানে,
রাজার মেয়ে চায় নীচে।
৩
সায়াহ্নে
রাজার ছেলে ঘরে ফিরিয়া আসে,
রাজার মেয়ে যায় ঘরে।
খুলিয়া গলা হতে মোতির মালা
রাজার মেয়ে খেলা করে।
পথে সে মালাখানি গেল ভুলে,
রাজার ছেলে সেটি নিল তুলে,
আপন মণিহার মনোভুলে
দিল সে বালিকার করে।
রাজার ছেলে ঘরে ফিরিয়া এল,
রাজার মেয়ে গেল ঘরে।
শ্রান্ত রবি ধীরে অস্ত যায়
নদীর তীরে একশেষে।
সাঙ্গ হয়ে গেল দোঁহার পাঠ,
যে যার গেল নিজ দেশে।
৪
নিশীথে
রাজার মেয়ে শোয় সোনার খাটে,
স্বপনে দেখে রূপরাশি।
রুপোর খাটে শুয়ে রাজার ছেলে
দেখিছে কার সুধা-হাসি।
করিছে আনাগোনা সুখ-দুখ,
কখনো দুরু দুরু করে বুক,
অধরে কভু কাঁপে হাসিটুক,
নয়ন কভু যায় ভাসি।
রাজার মেয়ে কার দেখিছে মুখ,
রাজার ছেলে কার হাসি।
বাদর ঝর ঝর, গরজে মেঘ,
পবন করে মাতামাতি।
শিথানে মাথা রাখি বিথান বেশ,
স্বপনে কেটে যায় রাতি।
লজ্জা
আমার হৃদয় প্রাণ
সকলই করেছি দান ,
কেবল শরমখানি রেখেছি ।
চাহিয়া নিজের পানে
নিশিদিন সাবধানে
সযতনে আপনারে ঢেকেছি ।
হে বঁধু , এ স্বচ্ছ বাস
করে মোরে পরিহাস ,
সতত রাখিতে নারি ধরিয়া —
চাহিয়া আঁখির কোণে
তুমি হাস মনে মনে ,
আমি তাই লাজে যাই মরিয়া ।
দক্ষিণপবনভরে
অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
কখন্ যে নাহি পারি লখিতে ।
পুলকব্যাকুল হিয়া
অঙ্গে উঠে বিকশিয়া ,
আবার চেতনা হয় চকিতে ।
বদ্ধ গৃহে করি বাস
রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
বসি গিয়া বাতায়নে ,
সুখসন্ধ্যাসমীরণে
ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া ।
পূর্ণচন্দ্রকররাশি
মূর্ছাতুর পড়ে আসি
এই নবযৌবনের মুকুলে ,
অঙ্গ মোর ভালোবেসে
ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
আপনার লাবণ্যের দুকূলে —
মুখে বক্ষে কেশপাশে
ফিরে বায়ু খেলা-আশে ,
কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে —
হেনকালে তুমি এলে
মনে হয় স্বপ্ন ব ' লে ,
কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে ।
থাক্ বঁধু , দাও ছেড়ে ,
ওটুকু নিয়ো না কেড়ে ,
এ শরম দাও মোরে রাখিতে —
সকলের অবশেষ
এইটুকু লাজলেশ
আপনারে আধখানি ঢাকিতে ।
ছলছল-দু ' নয়ান
করিয়ো না অভিমান ,
আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি ;
বুঝাতে পারি নে যেন
সব দিয়ে তবু কেন
সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি —
কেন যে তোমার কাছে
একটু গোপন আছে ,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে ।
এ নহে গো অবিশ্বাস —
নহে সখা , পরিহাস ,
নহে নহে ছলনার খেলা এ ।
বসন্তনিশীথে বঁধু ,
লহ গন্ধ , লহ মধু ,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো ।
দিয়ো দোল আশে-পাশে ,
কোয়ো কথা মৃদু ভাষে —
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ।
সেটুকুতে ভর করি
এমন মাধুরী ধরি
তোমাপানে আছি আমি ফুটিয়া ,
এমন মোহনভঙ্গে
আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া —
এমন সকল বেলা
পবনে চঞ্চল খেলা ,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি ।
শুন বঁধু , শুন তবে ,
সকলই তোমার হবে ,
কেবল শরম থাক্ আমারি ।
২৮ আষাঢ় ১৩০০
শৈশবসন্ধ্যা
ধীরে
ধীরে বিস্তারিছে
ঘেরি চারিধার
শ্রান্তি, আর শান্তি, আর সন্ধ্যা-অন্ধকার,
মায়ের অঞ্চলসম। দাঁড়ায়ে একাকী
মেলিয়া পশ্চিম-পানে অনিমেষ আঁখি
স্তব্ধ চেয়ে আছি। আপনারে মগ্ন করি
অতলের তলে, ধীরে লইতেছি ভরি
জীবনের মাঝে— আজিকার এই ছবি,
জনশূন্য নদীতীর, অস্তমান রবি,
ম্লান মূর্ছাতুর আলো— রোদন-অরুণ,
ক্লান্ত নয়নের যেন দৃষ্টি সকরুণ
স্থির বাক্যহীন— এই গভীর বিষাদ,
জলে স্থলে চরাচরে শ্রান্তি অবসাদ।
সহসা উঠিল গাহি কোন্খান হতে
বন-অন্ধকারঘন কোন্ গ্রামপথে
যেতে যেতে গৃহমুখে বালক-পথিক।
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর নিশ্চিন্ত নির্ভীক
কাঁপিছে সপ্তম সুরে, তীব্র উচ্চতান
সন্ধ্যারে কাটিয়া যেন করিবে দুখান।
দেখিতে না পাই তারে। ওই যে সম্মুখে
প্রান্তরের সর্বপ্রান্তে, দক্ষিণের মুখে,
আখের খেতের পারে, কদলী সুপারি
নিবিড় বাঁশের বন, মাঝখানে তারি
বিশ্রাম করিছে গ্রাম, হোথা আঁখি ধায়।
হোথা কোন্ গৃহপানে গেয়ে চলে যায়
কোন্ রাখালের ছেলে, নাহি ভাবে কিছু,
নাহি চায় শূন্যপানে, নাহি আগুপিছু।
শ্রান্তি, আর শান্তি, আর সন্ধ্যা-অন্ধকার,
মায়ের অঞ্চলসম। দাঁড়ায়ে একাকী
মেলিয়া পশ্চিম-পানে অনিমেষ আঁখি
স্তব্ধ চেয়ে আছি। আপনারে মগ্ন করি
অতলের তলে, ধীরে লইতেছি ভরি
জীবনের মাঝে— আজিকার এই ছবি,
জনশূন্য নদীতীর, অস্তমান রবি,
ম্লান মূর্ছাতুর আলো— রোদন-অরুণ,
ক্লান্ত নয়নের যেন দৃষ্টি সকরুণ
স্থির বাক্যহীন— এই গভীর বিষাদ,
জলে স্থলে চরাচরে শ্রান্তি অবসাদ।
সহসা উঠিল গাহি কোন্খান হতে
বন-অন্ধকারঘন কোন্ গ্রামপথে
যেতে যেতে গৃহমুখে বালক-পথিক।
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর নিশ্চিন্ত নির্ভীক
কাঁপিছে সপ্তম সুরে, তীব্র উচ্চতান
সন্ধ্যারে কাটিয়া যেন করিবে দুখান।
দেখিতে না পাই তারে। ওই যে সম্মুখে
প্রান্তরের সর্বপ্রান্তে, দক্ষিণের মুখে,
আখের খেতের পারে, কদলী সুপারি
নিবিড় বাঁশের বন, মাঝখানে তারি
বিশ্রাম করিছে গ্রাম, হোথা আঁখি ধায়।
হোথা কোন্ গৃহপানে গেয়ে চলে যায়
কোন্ রাখালের ছেলে, নাহি ভাবে কিছু,
নাহি চায় শূন্যপানে, নাহি আগুপিছু।
দেখে
শুনে মনে
পড়ে সেই
সন্ধ্যাবেলা
শৈশবের। কত গল্প, কত বাল্যখেলা,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন;
সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন।
এখনো কি বৃদ্ধ হয়ে যায় নি সংসার।
ভোলে নাই খেলাধুলা, নয়নে তাহার
আসে নাই নিদ্রাবেশ শান্ত সুশীতল,
বাল্যের খেলানাগুলি করিয়া বদল
পায় নি কঠিন জ্ঞান? দাঁড়ায়ে হেথায়
নির্জন মাঠের মাঝে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
শুনিয়া কাহার গান পড়ি গেল মনে—
কত শত নদীতীরে, কত আম্রবনে,
কাংস্যঘণ্টা-মুখরিত মন্দিরের ধারে,
কত শস্যক্ষেত্রপ্রান্তে, পুকুরের পাড়ে
গৃহে গৃহে জাগিতেছে নব হাসিমুখ,
নবীন হৃদয়ভরা নব নব সুখ,
কত অসম্ভব কথা, অপূর্ব কল্পনা,
কত অমূলক আশা, অশেষ কামনা,
অনন্ত বিশ্বাস। দাঁড়াইয়া অন্ধকারে
দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে
রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,
সন্ধ্যাশয্যা, মার মুখ, দীপের আলোক।
শৈশবের। কত গল্প, কত বাল্যখেলা,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন;
সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন।
এখনো কি বৃদ্ধ হয়ে যায় নি সংসার।
ভোলে নাই খেলাধুলা, নয়নে তাহার
আসে নাই নিদ্রাবেশ শান্ত সুশীতল,
বাল্যের খেলানাগুলি করিয়া বদল
পায় নি কঠিন জ্ঞান? দাঁড়ায়ে হেথায়
নির্জন মাঠের মাঝে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
শুনিয়া কাহার গান পড়ি গেল মনে—
কত শত নদীতীরে, কত আম্রবনে,
কাংস্যঘণ্টা-মুখরিত মন্দিরের ধারে,
কত শস্যক্ষেত্রপ্রান্তে, পুকুরের পাড়ে
গৃহে গৃহে জাগিতেছে নব হাসিমুখ,
নবীন হৃদয়ভরা নব নব সুখ,
কত অসম্ভব কথা, অপূর্ব কল্পনা,
কত অমূলক আশা, অশেষ কামনা,
অনন্ত বিশ্বাস। দাঁড়াইয়া অন্ধকারে
দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে
রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,
সন্ধ্যাশয্যা, মার মুখ, দীপের আলোক।
সমুদ্রের প্রতি
পুরীতে সমুদ্র দেখিয়া
হে আদিজননী সিন্ধু , বসুন্ধরা সন্তান তোমার ,
একমাত্র কন্যা তব কোলে । তাই তন্দ্রা নাহি আর
চক্ষে তব , তাই বক্ষ জুড়ি সদা শঙ্কা , সদা আশা ,
সদা আন্দোলন ; তাই উঠে বেদমন্ত্রসম ভাষা
নিরন্তর প্রশান্ত অম্বরে , মহেন্দ্রমন্দির-পানে
অন্তরের অনন্ত প্রার্থনা , নিয়ত মঙ্গলগানে
ধ্বনিত করিয়া দিশি দিশি ; তাই ঘুমন্ত পৃথ্বীরে
অসংখ্য চুম্বন কর আলিঙ্গনে সর্ব অঙ্গ ঘিরে
তরঙ্গবন্ধনে বাঁধি , নীলাম্বর অঞ্চলে তোমার
সযত্নে বেষ্টিয়া ধরি সন্তর্পণে দেহখানি তার
সুকোমল সুকৌশলে । এ কী সুগম্ভীর স্নেহখেলা
অম্বুনিধি , ছল করি দেখাইয়া মিথ্যা অবহেলা
ধীরি ধীরি পা টিপিয়া পিছু হটি যাও দূরে ,
যেন ছেড়ে যেতে চাও ; আবার আনন্দপূর্ণ সুরে
উল্লসি ফিরিয়া আসি কল্লোলে ঝাঁপায়ে পড় বুকে —
রাশি রাশি শুভ্রহাস্যে , অশ্রুজলে , স্নেহগর্বসুখে
র্আদ্র করি দিয়ে যাও ধরিত্রীর নির্মল ললাট
আশীর্বাদে । নিত্যবিগলিত তব অন্তর বিরাট ,
আদি অন্ত স্নেহরাশি — আদি অন্ত তাহার কোথা রে!
কোথা তার তল! কোথা কূল! বলো কে বুঝিতে পারে
তাহার অগাধ শান্তি , তাহার অপার ব্যাকুলতা ,
তার সুগভীর মৌন , তার সমুচ্ছল কলকথা ,
তার হাস্য , তার অশ্রুরাশি! — কখনো-বা আপনারে
রাখিতে পার না যেন , স্নেহপূর্ণস্ফীতস্তনভারে
উন্মাদিনী ছুটে এসে ধরণীরে বক্ষে ধর চাপি
নির্দয় আবেগে ; ধরা প্রচণ্ড পীড়নে উঠে কাঁপি ,
রুদ্ধশ্বাসে ঊর্ধ্বশ্বাসে চীৎকারি উঠিতে চাহে কাঁদি ,
উন্মত্ত স্নেহক্ষুধায় রাক্ষসীর মতো তারে বাঁধি
প্রকাণ্ড প্রলয়ে । পরক্ষণে মহা অপরাধীপ্রায়
পড়ে থাকে তটতলে স্তব্ধ হয়ে বিষণ্ন ব্যথায়
নিষণ্ন নিশ্চল — ধীরে ধীরে প্রভাত উঠিয়া এসে
শান্তদৃষ্টি চাহে তোমাপানে ; সন্ধ্যাসখী ভালোবেসে
স্নেহকরস্পর্শ দিয়ে সান্ত্বনা করিয়ে চুপেচুপে
চলে যায় তিমিরমন্দিরে ; রাত্রি শোনে বন্ধুরূপে
গুমরি ক্রন্দন তব রুদ্ধ অনুতাপে ফুলে ফুলে ।
আমি পৃথিবীর শিশু বসে আছি তব উপকূলে ,
শুনিতেছি ধ্বনি তব । ভাবিতেছি , বুঝা যায় যেন
কিছু কিছু মর্ম তার — বোবার ইঙ্গিতভাষা-হেন
আত্মীয়ের কাছে । মনে হয় , অন্তরের মাঝখানে
নাড়ীতে যে-রক্ত বহে , সেও যেন ওই ভাষা জানে ,
আর কিছু শেখে নাই । মনে হয় , যেন মনে পড়ে
যখন বিলীনভাবে ছিনু ওই বিরাট জঠরে
অজাত ভুবনভ্রূণ-মাঝে , লক্ষকোটি বর্ষ ধ ' রে
ওই তব অবিশ্রাম কলতান অন্তরে অন্তরে
মুদ্রিত হইয়া গেছে ; সেই জন্মপূর্বের স্মরণ ,
গর্ভস্থ পৃথিবী ' পরে সেই নিত্য জীবনস্পন্দন
তব মাতৃহৃদয়ের — অতি ক্ষীণ আভাসের মতো
জাগে যেন সমস্ত শিরায় , শুনি যবে নেত্র করি নত
বসি জনশূন্য তীরে ওই পুরাতন কলধ্বনি ।
দিক্ হতে দিগন্তরে যুগ হতে যুগান্তর গণি
তখন আছিলে তুমি একাকিনী অখণ্ড অকূল
আত্মহারা , প্রথম গর্ভের মহা রহস্য বিপুল
না বুঝিয়া । দিবারাত্রি গূঢ় এক স্নেহব্যাকুলতা ,
গর্ভিণীর পূর্বরাগ , অলক্ষিতে অপূর্ব মমতা ,
অজ্ঞাত আকাঙ্ক্ষারাশি , নিঃসন্তান শূন্য বক্ষোদেশে
নিরন্তর উঠিত ব্যাকুলি । প্রতি প্রাতে উষা এসে
অনুমান করি যেত মহাসন্তানের জন্মদিন ,
নক্ষত্র রহিত চাহি নিশি নিশি নিমেষবিহীন
শিশুহীন শয়ন-শিয়রে । সেই আদিজননীর
জনশূন্য জীবশূন্য স্নেহচঞ্চলতা সুগভীর ,
আসন্ন প্রতীক্ষাপূর্ণ সেই তব জাগ্রত বাসনা ,
অগাধ প্রাণের তলে সেই তব অজানা বেদনা
অনাগত মহাভবিষ্যৎ লাগি হৃদয়ে আমার
যুগান্তরস্মৃতিসম উদিত হতেছে বারম্বার ।
আমারো চিত্তের মাঝে তেমনি অজ্ঞাতব্যথাভরে ,
তেমনি অচেনা প্রত্যাশায় , অলক্ষ্য সুদূর-তরে
উঠিছে মর্মর স্বর । মানবহৃদয়-সিন্ধুতলে
যেন নব মহাদেশ সৃজন হতেছে পলে পলে ,
আপনি সে নাহি জানে । শুধু অর্ধ-অনুভব তারি
ব্যাকুল করেছে তারে , মনে তার দিয়েছে সঞ্চারি
আকারপ্রকারহীন তৃপ্তিহীন এক মহা আশা —
প্রমাণের অগোচর , প্রত্যক্ষের বাহিরেতে বাসা ।
তর্ক তারে পরিহাসে , মর্ম তারে সত্য বলি জানে ,
সহস্র ব্যাঘাত-মাঝে তবুও সে সন্দেহ না মানে ,
জননী যেমন জানে জঠরের গোপন শিশুরে ,
প্রাণে যবে স্নেহ জাগে , স্তনে যবে দুগ্ধ উঠে পূরে ।
প্রাণভরা ভাষাহরা দিশাহারা সেই আশা নিয়ে
চেয়ে আছি তোমা পানে ; তুমি সিন্ধু , প্রকাণ্ড হাসিয়ে
টানিয়া নিতেছ যেন মহাবেগে কী নাড়ীর টানে
আমার এ মর্মখানি তোমার তরঙ্গ-মাঝখানে
কোলের শিশুর মতো ।
হে জলধি , বুঝিবে কি তুমি
আমার মানবভাষা । জান কি তোমার ধরাভূমি
পীড়ায় পীড়িত আজি ফিরিতেছে এ-পাশ ও-পাশ ,
চক্ষে বহে অশ্রুধারা , ঘন ঘন বহে উষ্ণ শ্বাস ।
নাহি জানে কী যে চায় , নাহি জানে কিসে ঘুচে তৃষা ,
আপনার মনোমাঝে আপনি সে হারায়েছে দিশা
বিকারের মরীচিকা-জালে । অতল গম্ভীর তব
পীড়িয়া নাড়িয়া যেন টুটিয়া ফেলিয়া একেবারে
অসীম অতৃপ্তিমাঝে গ্রাসিতে নাশিতে চাহ তারে
অন্তর হইতে কহ সান্ত্বনার বাক্য অভিনব
আষাঢ়ের জলদমন্দ্রের মতো ; স্নিগ্ধ মাতৃপাণি
চিন্তাতপ্ত ভালে তার তালে তালে বারম্বার হানি ,
সর্বাঙ্গে সহস্রবার দিয়া তারে স্নেহময় চুমা ,
বলো তার ‘ শান্তি , শান্তি ' , বলো তারে ‘ ঘুমা , ঘুমা , ঘুমা ' ।
সুপ্তোত্থিতা
ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম,
উঠিল কলস্বর।
গাছের শাখে জাগিল পাখি
কুসুমে মধুকর।
অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া,
হস্তিশালে হাতি।
মল্লশালে মল্ল জাগি
ফুলায় পুন ছাতি।
জাগিল পথে প্রহরিদল,
দুয়ারে জাগে দ্বারী।
আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা
জাগিয়া নরনারী।
উঠিল জাগি রাজাধিরাজ,
জাগিল রানীমাতা।
কচালি আঁখি কুমার-সাথে
জাগিল রাজভ্রাতা।
নিভৃত ঘরে ধূপের বাস,
রতন-দীপ জ্বালা,
জাগিয়া উঠি শয্যাতলে
শুধাল রাজবালা—
কে পরালে মালা!
খসিয়া-পড়া আঁচলখানি
বক্ষে তুলি দিল।
আপন-পানে নেহারি চেয়ে
শরমে শিহরিল।
ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে
চাহিল চারিদিকে,
বিজন গৃহ, রতন-দীপ
জ্বলিছে অনিমিখে।
গলার মালা খুলিয়া লয়ে
ধরিয়া দুটি করে
সোনার সুতে যতনে গাঁথা
লিখনখানি পড়ে।
পড়িল নাম, পড়িল ধাম,
পড়িল লিপি তার,
কোলের ‘পরে বিছায়ে দিয়ে
পড়িল শতবার।
শয়নশেষে রহিল বসে,
ভাবিল রাজবালা—
আপন ঘরে ঘুমায়েছিনু
নিতান্ত নিরালা—
কে পরালে মালা!
নূতন-জাগা কুঞ্জবনে
কুহরি উঠে পিক,
বসন্তের চুম্বনেতে
বিবশ দশ দিক।
বাতাস ঘরে প্রবেশ করে
ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে,
নবীন ফুলমঞ্জরির
গন্ধ লয়ে আসে।
জাগিয়া উঠি বৈতালিক
গাহিছে জয়গান,
প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে
বাঁশিতে উঠে তান।
শীতলছায়া নদীর পথে
কলসে লয়ে বারি—
কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে—
চলিছে পুরনারী।
কাননপথে মর্মরিয়া
কাঁপিছে গাছপালা,
আধেক মুদি নয়ন দুটি
ভাবিছে রাজবালা—
কে পরালে মালা!
বারেক মালা গলায় পরে,
বারেক লহে খুলি,
দুইটি করে চাপিয়া ধরে
বুকের কাছে তুলি।
শয়ন’পরে মেলায়ে দিয়ে
তৃষিত চেয়ে রয়,
এমনি করে পাইবে যেন
অধিক পরিচয়।
জগতে আজ কত-না ধ্বনি
উঠিছে কত ছলে—
একটি আছে গোপন কথা,
সে কেহ নাহি বলে।
বাতাস শুধু কানের কাছে
বহিয়া যায় হূহু,
কোকিল শুধু অবিশ্রাম
ডাকিছে কুহু কুহু।
নিভৃত ঘরে পরান-মন
একান্ত উতালা,
শয়নশেষে নীরবে বসে
ভাবিছে রাজবালা—
কে পরালে মালা!
কেমন বীর-মুরতি তার
মাধুরী দিয়ে মিশা।
দীপ্তিভরা নয়নমাঝে
তৃপ্তিহীন তৃষা।
স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন
এমনি মনে লয়—
ভুলিয়া গেছে, রয়েছে শুধু
অসীম বিস্ময়।
পারশে যেন বসিয়াছিল,
ধরিয়াছিল কর,
এখনো তার পরশে যেন
সরস কলেবর।
চমকি মুখ দু-হাতে ঢাকে,
শরমে টুটে মন,
লজ্জাহীন প্রদীপ কেন
নিভে নি সেই ক্ষণ।
কণ্ঠ হতে ফেলিল হার
যেন বিজুলিজ্বালা,
শয়ন’পরে লুটায়ে পড়ে
ভাবিল রাজবালা—
কে পরালে মালা!
এমনি ধীরে একটি করে
কাটিছে দিন রাতি।
বসন্ত সে বিদায় নিল
লইয়া যূথী-জাতি।
সঘন মেঘে বরষা আসে,
বরষে ঝরঝর্।
কাননে ফুটে নবমালতী
কদম্বকেশর।
স্বচ্ছ হাসি শরৎ আসে
পূর্ণিমামালিকা।
সকল বন আকুল করে
শুভ্র শেফালিকা।
আসিল শীত সঙ্গে লয়ে
দীর্ঘ দুখনিশা।
শিশির-ঝরা কুন্দফুলে
হাসিয়া কাঁদে দিশা।
ফাগুন মাস আবার এল
বহিয়া ফুলডালা।
জানালা-পাশে একেলা বসে
ভাবিছে রাজবালা—
কে পরালে মালা!
সোনার তরী
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা—
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে—
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-’পরে।
আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে—
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
সোনার বাঁধন
বন্দী হয়ে আছ তুমি সুমধুর স্নেহে
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণক্রন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কণ দুটি বহিতেছে দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়ননন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুন্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজে
বহ্নিবাণ বজ্রসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্রেম-করুণার মাঝে—
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখানি।
হিং টিং ছট্
স্বপ্নমঙ্গল
স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ ,
অর্থ তার ভাবি ভাবি গবুচন্দ্র চুপ ।
শিয়রে বসিয়ে যেন তিনটে বাঁদরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে ।
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় ,
চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় ।
সহসা মিলাল তারা , এল এক বেদে ,
‘ পাখি উড়ে গেছে ' ব ' লে মরে কেঁদে কেঁদে ;
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে ,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে ।
নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়্থুড়ি
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়্সুড়ি ।
রাজা বলে , ‘ কী আপদ! ' কেহ নাহি ছাড়ে ,
পা দুটা তুলিতে চাহে , তুলিতে না পারে ।
পাখির মতন রাজা করে ঝট্পট্ ,
বেদে কানে কানে বলে — ‘ হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয়-সাত
চোখে কারো নিদ্রা নাই , পেটে নাই ভাত ।
শীর্ণ গালে হাত দিয়ে নত করি শির
রাজ্যসুদ্ধ বালবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির ।
ছেলেরা ভুলেছে খেলা , পণ্ডিতেরা পাঠ ,
মেয়েরা করেছে চুপ — এতই বিভ্রাট ।
সারি সারি বসে গেছে কথা নাহি মুখে ,
চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পড়ে ঝুঁকে ।
ভুঁইফোঁড়া তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে ,
সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে ।
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
হঠাৎ ফুকারি উঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
চারি দিক হতে এল পণ্ডিতের দল —
অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল ।
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
কালিদাস-কবীন্দ্রের ভাগিনেয়বংশ ।
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা ,
ঘন ঘন নাড়ে বসি টিকিসুদ্ধ মাথা ।
বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যখেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ-সমেত ।
কেহ শ্রুতি , কেহ স্মৃতি , কেহবা পুরাণ ,
কেহ ব্যাকরণ দেখে , কেহ অভিধান ।
কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ ,
বেড়ে ওঠে অনুস্বর-বিসর্গের স্তূপ ।
চুপ করে বসে থাকে বিষম সংকট ,
থেকে থেকে হেঁকে ওঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ ,
‘ ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পণ্ডিত-সমাজ ,
তাহাদের ডেকে আনো যে যেখানে আছে —
অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে । '
কটাচুল নীলচক্ষু কপিশকপোল ,
যবন পণ্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল ।
গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোঁটা কুর্তি ,
গ্রীষ্মতাপে উষ্মা বাড়ে , ভারি উগ্রমূর্তি ।
ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয় —
‘ সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময় ,
কথা যদি থাকে কিছু বলো চট্পট্ । '
সভাসুদ্ধ বলি উঠে — ‘ হিং টিং ছট্ । '
‘ স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে ,
আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে ।
হানিয়া দক্ষিণ মুষ্টি বাম করতলে
‘ ডেকে এনে পরিহাস ' রেগেমেগে বলে ।
ফরাসি পণ্ডিত ছিল , হাস্যোজ্জ্বলমুখে
কহিল নোয়ায়ে মাথা , হস্ত রাখি বুকে ,
‘ স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে ;
হেন স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে ।
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান ।
অর্থ চাই , রাজকোষে আছে ভূরি ভূরি
রাজস্বপ্নে অর্থ নাই , যত মাথা খুঁড়ি ।
নাই অর্থ কিন্তু তবু কহি অকপট ,
শুনিতে কী মিষ্ট আহা , হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক্ ধিক্ —
কোথাকার গণ্ডমূর্খ পাষণ্ড নাস্তিক!
স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিষ্ক-বিকার ,
এ কথা কেমন করে করিব স্বীকার ।
জগৎ-বিখ্যাত মোরা ‘ ধর্মপ্রাণ ' জাতি
স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে! — দুপুরে ডাকাতি!
হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখ —
‘ গবুচন্দ্র , এদের উচিত শিক্ষা হোক ।
হেঁটোয় কণ্টক দাও , উপরে কণ্টক ,
ডালকুত্তাদের মাঝে করহ বণ্টন । '
সতেরো মিনিট কাল না হইতে শেষ ,
ম্লেচ্ছ পণ্ডিতের আর না মিলে উদ্দেশ ।
সভাস্থ সবাই ভাসে আনন্দাশ্রুনীরে ,
ধর্মরাজ্যে পুনর্বার শান্তি এল ফিরে ।
পণ্ডিতেরা মুখ চক্ষু করিয়া বিকট
পুনর্বার উচ্চারিল — ‘ হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
অতঃপর গৌড় হতে এল হেন বেলা
যবন পণ্ডিতদের গুরুমারা চেলা ।
নগ্নশির , সজ্জা নাই , লজ্জা নাই ধড়ে —
কাছা-কোঁচা শতবার খসে খসে পড়ে ।
অস্তিত্ব আছে না আছে , ক্ষীণ খর্বদেহ ,
বাক্য যবে বাহিরায় না থাকে সন্দেহ ।
এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময় ।
না জানে অভিবাদন , না পুছে কুশল ,
পিতৃনাম শুধাইলে উদ্যত মুষল ।
সগর্বে জিজ্ঞাসা করে , ‘ কী লয়ে বিচার ,
শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই-চার ,
ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট-পালট । '
সমস্বরে কহে সবে — ‘ হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
স্বপ্নকথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া ,
‘ নিতান্ত সরল অর্থ , অতি পরিষ্কার ,
বহু পুরাতন ভাব , নব আবিষ্কার ।
ত্র্যম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যক্তিভেদ দ্বিগুণ বিগুণ ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বদী ।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আণব চৌম্বকবলে আকৃতি বিকৃতি ।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরমা শক্তি সেথায় উদ্ভূত ।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপজ্ঞে প্রকট —
সংক্ষেপে বলিতে গেলে , হিং টিং ছট্ । '
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
‘ সাধু সাধু ' রবে কাঁপে চারিধার ,
সবে বলে — পরিষ্কার অতি পরিষ্কার ।
দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল ,
শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল ।
হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ ,
আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে ,
ভারে তার মাথাটুকু পড়ে বুঝি ছিঁড়ে ।
বহুদিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে ,
হাবুডুবু হবু-রাজ্য নড়িচড়ি উঠে ।
ছেলেরা ধরিল খেলা , বৃদ্ধেরা তামুক ,
এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ ।
দেশজোড়া মাথাধরা ছেড়ে গেল চট্ ,
সবাই বুঝিয়া গেল — হিং টিং ছট্ ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
যে শুনিবে এই স্বপ্নমঙ্গলের কথা ,
সর্বভ্রম ঘুচে যাবে নহিবে অন্যথা ।
বিশ্বে কভু বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে ,
সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে ।
যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে ,
এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে ।
সবাই সরলভাবে দেখিবে যা কিছু ,
সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু ।
এসো ভাই , তোলো হাই , শুয়ে পড়ো চিত ,
অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত —
জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়াময় ,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে , শুনে পুণ্যবান ।
হৃদয়যমুনা
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ , এসো ওগো , এসো মোর
হৃদয়নীরে ।
তলতল ছলছল কাঁদিবে গভীর জল
ওই দুটি সুকোমল চরণ ঘিরে ।
আজি বর্ষা গাঢ়তম , নিবিড়কুন্তলসম
মেঘ নামিয়াছে মম দুইটি তীরে ।
ওই যে শবদ চিনি নূপুর-রিনিকিঝিনি ,
কে গো তুমি একাকিনী আসিছ ধীরে ।
যদি ভরিয়া লইবে কুম্ভ , এসো ওগো , এসো মোর
হৃদয়নীরে ।
যদি কলস ভাসায়ে জলে বসিয়া থাকিতে চাও
আপনা ভুলে —
হেথা শ্যাম দূর্বাদল , নবনীল নভস্তল ,
বিকশিত বনস্থল বিকচ ফুলে ।
দুটি কালো আঁখি দিয়া মন যাবে বাহিরিয়া
অঞ্চল খসিয়া গিয়া পড়িবে খুলে ।
চাহিয়া বঞ্জুলবনে কী জানি পড়িবে মনে
বসি কুঞ্জে তৃণাসনে শ্যামল কূলে!
যদি কলস ভাসায়ে জলে বসিয়া থাকিতে চাও
আপনা ভুলে ।
যদি গাহন করিতে চাহ , এসো নেমে এসো হেথা
গহনতলে ।
নীলাম্বরে কিবা কাজ , তীরে ফেলে এসো আজ ,
ঢেকে দিবে সব লাজ সুনীল জলে ।
সোহাগ-তরঙ্গরাশি অঙ্গখানি দিবে গ্রাসি ,
উচ্ছ্বসি পড়িবে আসি উরসে গলে —
ঘুরে ফিরে চারি পাশে কভু কাঁদে কভু হাসে ,
কুলুকুলু কলভাষে কত কী ছলে!
যদি গাহন করিতে চাহ , এসো নেমে এসো হেথা
গহনতলে ।
যদি মরণ লভিতে চাও , এসো তবে ঝাঁপ দাও
সলিলমাঝে ।
স্নিগ্ধ , শান্ত , সুগভীর , নাহি তল , নাহি তীর ,
মৃত্যুসম নীল নীর স্থির বিরাজে ।
নাহি রাত্রি দিনমান — আদি অন্ত পরিমাণ ,
সে অতলে গীতগান কিছু না বাজে ।
যাও সব যাও ভুলে , নিখিল বন্ধন খুলে
ফেলে দিয়ে এসো কূলে সকল কাজে ।
যদি মরণ লভিতে চাও , এসো তবে ঝাঁপ দাও
সলিলমাঝে ।
No comments:
Post a Comment