সোনার তরী (কাব্যগ্রন্থ)
|
কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল
১৩০০ (১৮৯৪)।
|
উৎসর্গ
কবি-ভ্রাতা শ্রীদেবেন্দ্রনাথ সেন
মহাশয়ের করকমলে
তদীয় ভক্তের এই
প্রীতি-উপহার
সাদরে সমর্পিত
হইল
কবি-ভ্রাতা শ্রীদেবেন্দ্রনাথ সেন
মহাশয়ের করকমলে
তদীয় ভক্তের এই
প্রীতি-উপহার
সাদরে সমর্পিত
হইল
- সূচনা
- সোনার তরী
- বিম্ববতী
- শৈশবসন্ধ্যা
- রাজার ছেলে ও রাজার মেয়ে
- নিদ্রিতা
- সুপ্তোত্থিতা
- তোমরা ও আমরা
- সোনার বাঁধন
- বর্ষাযাপন
- হিং টিং ছট্
- পরশপাথর
- বৈষ্ণবকবিতা
- দুই পাখি
- আকাশের চাঁদ
- যেতে নাহি দিব
- সমুদ্রের প্রতি
- প্রতীক্ষা
- মানসসুন্দরী
- অনাদৃত
- নদীপথে
- দেউল
- বিশ্বনৃত্য
- দুর্বোধ
- ঝুলন
- হৃদয়যমুনা
- ব্যর্থ যৌবন
- ভরা ভাদরে
- প্রত্যাখ্যান
- লজ্জা
- পুরস্কার
- বসুন্ধরা
- মায়াবাদ
- খেলা
- বন্ধন
- গতি
- মু্ক্তি
- অক্ষমা
- দরিদ্রা
- আত্মসমর্পণ
- অচল স্মৃতি
- কণ্টকের কথা
- নিরুদ্দেশ যাত্রা
অক্ষমা
যেখানে
এসেছি আমি
, আমি সেথাকার
,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর ।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির ।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে ,
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী ।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে ,
পারিস নে কত বার — ‘কই অন্ন কই ‘
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ ।
জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ —
যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,
সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর ।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখদুঃখভার
বহু ভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির ।
অসীম ঐশ্বর্যরাশি নাই তোর হাতে ,
হে শ্যামলা সর্বসহা জননী মৃন্ময়ী ।
সকলের মুখে অন্ন চাহিস জোগাতে ,
পারিস নে কত বার — ‘কই অন্ন কই ‘
কাঁদে তোর সন্তানেরা ম্লান শুষ্ক মুখ ।
জানি মা গো , তোর হাতে অসম্পূর্ণ সুখ —
যা কিছু গড়িয়া দিস ভেঙে ভেঙে যায় ,
সব-তাতে হাত দেয় মৃত্যু সর্বভুক ,
সব আশা মিটাইতে পারিস নে হায়—
তা বলে কি ছেড়ে যাব তোর তপ্ত বুক!
অচল স্মৃতি
আমার হৃদয়ভূমি-মাঝখানে
জাগিয়া রয়েছে নিতি
অচল ধবল শৈল-সমান
একটি অচল স্মৃতি ।
প্রতিদিন ঘিরি ঘিরি
সে নীরব হিমগিরি
আমার দিবস আমার রজনী
আসিছে যেতেছে ফিরি ।
যেখানে চরণ রেখেছে সে মোর
মর্ম গভীরতম —
উন্নত শির রয়েছে তুলিয়া
সকল উচ্চে মম ।
মোর কল্পনা শত
রঙিন মেঘের মতো
তাহারে ঘেরিয়া হাসিছে কাঁদিছে ,
সোহাগে হতেছে নত ।
আমার শ্যামল তরুলতাগুলি
ফুলপল্লবভারে
সরস কোমল বাহুবেষ্টনে
বাঁধিতে চাহিছে তারে ।
শিখর গগনলীন
দুর্গম জনহীন ,
বাসনাবিহগ একেলা সেথায়
ধাইছে রাত্রিদিন ।
চারি দিকে তার কত আসা-যাওয়া ,
কত গীত , কত কথা —
মাঝখানে শুধু ধ্যানের মতন
নিশ্চল নীরবতা ।
দূরে গেলে তবু , একা
সে শিখর যায় দেখা —
চিত্তগগনে আঁকা থাকে তার
নিত্যনীহাররেখা ।
অনাদৃত
তখন তরুণ রবি প্রভাতকালে
আনিছে উষার পূজা সোনার থালে ।
সীমাহীন নীল জল
করিতেছে থলথল্ ,
রাঙা রেখা জ্বলজ্বল্
কিরণমালে ।
তখন উঠিছে রবি গগনভালে ।
গাঁথিতেছিলাম জাল বসিয়া তীরে ।
বারেক অতল-পানে চাহিনু ধীরে —
শুনিনু কাহার বাণী
পরান লইল টানি ,
যতনে সে জালখানি
তুলিয়া শিরে
ঘুরায়ে ফেলিয়া দিনু সুদূর নীরে ।
নাহি জানি কত কী যে উঠিল জালে ।
কোনোটা হাসির মতো কিরণ ঢালে ,
কোনোটা বা টলটল্
কঠিন নয়নজল ,
কোনোটা শরম-ছল
বধূর গালে —
সেদিন সাগরতীরে প্রভাতকালে ।
বেলা বেড়ে ওঠে , রবি ছাড়ি পুরবে
গগনের মাঝখানে ওঠে গরবে ।
ক্ষুধাতৃষ্ণা সব ভুলি
জাল ফেলে টেনে তুলি —
উঠিল গোধূলি-ধূলি
ধূসর নভে ,
গাভীগণ গৃহে ধায় হরষ-রবে ।
লয়ে দিবসের ভার ফিরিনু ঘরে ,
তখন উঠিছে চাঁদ আকাশ- ' পরে ।
গ্রামপথে নাহি লোক ,
পড়ে আছে ছায়ালোক ,
মুদে আসে দুটি চোখ
স্বপনভরে ;
ডাকিছে বিরহী পাখি কাতর স্বরে ।
সে তখন গৃহকাজ সমাধা করি
কাননে বসিয়া ছিল মালাটি পরি ।
কুসুম একটি দুটি
তরু হতে পড়ে টুটি ,
সে করিছে কুটিকুটি
নখেতে ধরি ;
আলসে আপন মনে সময় হরি ।
বারেক আগিয়ে যাই , বারেক পিছু ।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালেম , নয়ন নিচু ।
যা ছিল চরণে রেখে
ভূমিতল দিনু ঢেকে ,
সে কহিল দেখে দেখে ,
‘ চিনি নে কিছু । ' —
শুনি রহিলাম শির করিয়া নিচু ।
ভাবিলাম , সারাদিন সারাটি বেলা
বসে বসে করিয়াছি কী ছেলেখেলা!
না জানি কী মোহে ভুলে
গেনু অকূলের কূলে ,
ঝাঁপ দিনু কুতূহলে —
আনিনু মেলা
অজানা সাগর হতে অজানা ঢেলা ।
যুঝি নাই , খুঁজি নাই হাটের মাঝে —
এমন হেলার ধন দেওয়া কি সাজে!
কোনো দুখ নাহি যার
কোনো তৃষা বাসনার
এ-সব লাগিবে তার
কিসের কাজে!
কুড়ায়ে লইনু পুন মনের লাজে ।
সারাটি রজনী বসি দুয়ারদেশে
একে একে ফেলে দিনু পথের শেষে ।
সুখহীন ধনহীন
চলে গেনু উদাসীন —
প্রভাতে পরের দিন
পথিকে এসে
সব তুলে নিয়ে গেল আপন দেশে ।
আকাশের চাঁদ
হাতে তুলে দাও আকাশের চাঁদ —
এই হল তার বুলি ।
দিবস রজনী যেতেছে বহিয়া ,
কাঁদে সে দু হাত তুলি ।
হাসিছে আকাশ , বহিছে বাতাস ,
পাখিরা গাহিছে সুখে ।
সকালে রাখাল চলিয়াছে মাঠে ,
বিকালে ঘরের মুখে ।
বালক বালিকা ভাই বোনে মিলে
খেলিছে আঙিনা-কোণে ,
কোলের শিশুরে হেরিয়া জননী
হাসিছে আপন মনে ।
কেহ হাটে যায় কেহ বাটে যায়
চলেছে যে যার কাজে —
কত জনরব কত কলরব
উঠিছে আকাশমাঝে ।
পথিকেরা এসে তাহারে শুধায় ,
‘ কে তুমি কাঁদিছ বসি । '
সে কেবল বলে নয়নের জলে ,
‘ হাতে পাই নাই শশী । '
সকালে বিকালে ঝরি পড়ে কোলে
অযাচিত ফুলদল ,
দখিন সমীর বুলায় ললাটে
দক্ষিণ করতল ।
প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
করিছে তাহার দেহে ,
রজনী তাহারে বুকের আঁচলে
ঢাকিছে নীরব স্নেহে ।
কাছে আসি শিশু মাগিছে আদর
কণ্ঠ জড়ায়ে ধরি ,
পাশে আসি যুবা চাহিছে তাহারে
লইতে বন্ধু করি ।
এই পথে গৃহে কত আনাগোনা ,
কত ভালোবাসাবাসি ,
সংসারসুখ কাছে কাছে তার
কত আসে যায় ভাসি ,
মুখ ফিরাইয়া সে রহে বসিয়া ,
কহে সে নয়নজলে ,
‘ তোমাদের আমি চাহি না কারেও ,
শশী চাই করতলে । '
শশী যেথা ছিল সেথাই রহিল ,
সেও ব ' সে এক ঠাঁই ।
অবশেষে যবে জীবনের দিন
আর বেশি বাকি নাই ,
এমন সময়ে সহসা কী ভাবি
চাহিল সে মুখ ফিরে
দেখিল ধরণী শ্যামল মধুর
সুনীল সিন্ধুতীরে ।
সোনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া
কাটিতেছে পাকা ধান ,
ছোটো ছোটো তরী পাল তুলে যায় ,
মাঝি বসে গায় গান ।
দূরে মন্দিরে বাজিছে কাঁসর ,
বধূরা চলেছে ঘাটে ,
মেঠো পথ দিয়ে গৃহস্থ জন
আসিছে গ্রামের হাটে ।
নিশ্বাস ফেলি রহে আঁখি মেলি ,
কহে ম্রিয়মাণ মন ,
‘ শশী নাহি চাই যদি ফিরে পাই
আর বার এ জীবন । '
দেখিল চাহিয়া জীবনপূর্ণ
সুন্দর লোকালয়
প্রতি দিবসের হরষে বিষাদে
চির-কল্লোলময় ।
স্নেহসুধা লয়ে গৃহের লক্ষ্মী
ফিরিছে গৃহের মাঝে ,
প্রতি দিবসেরে করিছে মধুর
প্রতি দিবসের কাজে ।
সকাল বিকাল দুটি ভাই আসে
ঘরের ছেলের মতো ,
রজনী সবারে কোলেতে লইছে
নয়ন করিয়া নত ।
ছোটো ছোটো ফুল , ছোটো ছোটো হাসি ,
ছোটো কথা , ছোটো সুখ ,
প্রতি নিমেষের ভালোবাসাগুলি ,
ছোটো ছোটো হাসিমুখ
আপনা-আপনি উঠিছে ফুটিয়া
মানবজীবন ঘিরি ,
বিজন শিখরে বসিয়া সে তাই
দেখিতেছে ফিরি ফিরি ।
দেখে বহুদূরে ছায়াপুরী-সম
অতীত জীবন-রেখা ,
অস্তরবির সোনার কিরণে
নূতন বরনে লেখা ।
যাহাদের পানে নয়ন তুলিয়া
চাহে নি কখনো ফিরে ,
নবীন আভায় দেখা দেয় তারা
স্মৃতিসাগরের তীরে ।
হতাশ হৃদয়ে কাঁদিয়া কাঁদিয়া
পুরবীরাগিণী বাজে ,
দু-বাহু বাড়ায়ে ফিরে যেতে চায়
ওই জীবনের মাঝে ।
দিনের আলোক মিলায়ে আসিল
তবু পিছে চেয়ে রহে —
যাহা পেয়েছিল তাই পেতে চায়
তার বেশি কিছু নহে ।
সোনার জীবন রহিল পড়িয়া
কোথা সে চলিল ভেসে ।
শশীর লাগিয়া কাঁদিতে গেল কি
রবিশশীহীন দেশে ।
আত্মসমর্পণ
তোমার
আনন্দগানে আমি দিব সুর
যাহা জানি দু-একটি প্রীতিসুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা ; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কণ্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কণ্ঠের সনে ; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি ; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমন্তে ভালে ; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি , প্রমোদসিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে ।
মানব-আত্মার গর্ব আর নাহি মোর ,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর ।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে ।
যাহা জানি দু-একটি প্রীতিসুমধুর
অন্তরের ছন্দোগাথা ; দুঃখের ক্রন্দনে
বাজিবে আমার কণ্ঠ বিষাদবিধুর
তোমার কণ্ঠের সনে ; কুসুমে চন্দনে
তোমারে পূজিব আমি ; পরাব সিন্দূর
তোমার সীমন্তে ভালে ; বিচিত্র বন্ধনে
তোমারে বাঁধিব আমি , প্রমোদসিন্ধুর
তরঙ্গেতে দিব দোলা নব ছন্দে তানে ।
মানব-আত্মার গর্ব আর নাহি মোর ,
চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃমুখ-পানে
ভালোবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর ।
জন্মেছি যে মর্ত-কোলে ঘৃণা করি তারে
ছুটিব না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে ।
কন্টকের কথা
একদা পুলকে প্রভাত-আলোকে
গাহিছে পাখি ,
কহে কণ্টক বাঁকা কটাক্ষে
কুসুমে ডাকি —
তুমি তো কোমল বিলাসী কমল ,
দুলায় বায়ু ,
দিনের কিরণ ফুরাতে ফুরাতে
ফুরায় আয়ু ;
এ পাশে মধুপ মধুমদে ভোর ,
ও পাশে পবন পরিমল-চোর ,
বনের দুলাল , হাসি পায় তোর
আদর দেখে ।
আহা মরি মরি কী রঙিন বেশ ,
সোহাগহাসির নাহি আর শেষ ,
সারাবেলা ধরি রসালসাবেশ
গন্ধ মেখে ।
হায় কদিনের আদর-সোহাগ ,
সাধের খেলা
ললিত মাধুরী , রঙিন বিলাস ,
মধুপ-মেলা ।
‘ওগো নহি আমি তোদের মতন
সুখের প্রাণী —
হাব ভাব হাস , নানারঙা বাস
নাহিকো জানি ।
রয়েছি নগ্ন , জগতে লগ্ন
আপন বলে ;
কে পারে তাড়াতে , আমারে মাড়াতে
ধরণীতলে ।
তোদের মতন নহি নিমেষের ,
আমি এ নিখিলে চিরদিবসের ,
বৃষ্টি-বাদল ঝড়-বাতাসের
না রাখি ভয় ।
সতত একাকী , সঙ্গীবিহীন —
কারো কাছে কোনো নাহি প্রেম-ঋণ ,
চাটুগান শুনি সারা নিশিদিন
করি না ক্ষয় ।
আসিবে তো শীত , বিহঙ্গগীত
যাইবে থামি ,
ফুলপল্লব ঝরে যাবে সব —
রহিব আমি ।
চেয়ে দেখো মোরে , কোনো বাহুল্য
কোথাও নাই ,
স্পষ্ট সকলি আমার মূল্য
জানে সবাই ।
এ ভীরু জগতে যার কাঠিন্য
জগৎ তারি ।
নখের আঁচড়ে আপন চিহ্ন
রাখিতে পারি ।
কেহ জগতেরে চামর ঢুলায় ,
চরণে কোমল হস্ত বুলায় ,
নতমস্তকে লুটায়ে ধুলায়
প্রণাম করে ।
ভুলাইতে মন কত করে ছল —
কাহারো বর্ণ , কারো পরিমল ,
বিফল বাসরসজ্জা , কেবল
দুদিন-তরে ।
কিছুই করি না , নীরবে দাঁড়ায়ে
তুলিয়া শির
বিঁধিয়া রয়েছি অন্তর-মাঝে
এ পৃথিবীর ।
'আমারে তোমরা চাহ না চাহিতে
চোখের কোণে ,
গরবে ফাটিয়া উঠেছ ফুটিয়া
আপন মনে ।
আছে তব মধু , থাক্ সে তোমার
আমার নাহি ।
আছে তব রূপ মোর পানে কেহ
দেখে না চাহি ।
কারো আছে শাখা , কারো আছে দল ,
কারো আছে ফুল , কারো আছে ফল ,
আমারি হস্ত রিক্ত কেবল
দিবসযামী ।
ওহে তরু , তুমি বৃহৎ প্রবীণ ,
আমাদের প্রতি অতি উদাসীন —
আমি বড়ো নহি , আমি ছায়াহীন ,
ক্ষুদ্র আমি ।
হই না ক্ষুদ্র , তবুও রুদ্র
ভীষণ ভয় —
আমার দৈন্য সে মোর সৈন্য ,
তাহারি জয় ।'
খেলা
হোক
খেলা , এ
খেলায় যোগ
দিতে হবে
আনন্দকল্লোলাকুল নিখিলের সনে ।
সব ছেড়ে মৌনী হয়ে কোথা বসে রবে
আপনার অন্তরের অন্ধকার কোণে!
জেনো মনে শিশু তুমি এ বিপুল ভবে
অনন্ত কালের কোলে , গগনপ্রাঙ্গণে —
যত জান মনে কর কিছুই জান না ।
বিনয়ে বিশ্বাসে প্রেমে হাতে লহ তুলি
বর্ণগন্ধগীতময় যে মহা-খেলনা
তোমারে দিয়াছে মাতা ; হয় যদি ধূলি
হোক ধূলি , এ ধূলির কোথায় তুলনা!
থেকো না অকালবৃদ্ধ বসিয়া একেলা —
কেমনে মানুষ হবে না করিলে খেলা!
আনন্দকল্লোলাকুল নিখিলের সনে ।
সব ছেড়ে মৌনী হয়ে কোথা বসে রবে
আপনার অন্তরের অন্ধকার কোণে!
জেনো মনে শিশু তুমি এ বিপুল ভবে
অনন্ত কালের কোলে , গগনপ্রাঙ্গণে —
যত জান মনে কর কিছুই জান না ।
বিনয়ে বিশ্বাসে প্রেমে হাতে লহ তুলি
বর্ণগন্ধগীতময় যে মহা-খেলনা
তোমারে দিয়াছে মাতা ; হয় যদি ধূলি
হোক ধূলি , এ ধূলির কোথায় তুলনা!
থেকো না অকালবৃদ্ধ বসিয়া একেলা —
কেমনে মানুষ হবে না করিলে খেলা!
গতি
জানি
আমি সুখে
দুঃখে হাসি
ও ক্রন্দনে
পরিপূর্ণ এ জীবন , কঠোর বন্ধনে
ক্ষতচিহ্ন পড়ে যায় গ্রনিথতে গ্রনিথতে ,
জানি আমি , সংসারের সমুদ্র মনিথতে
কারো ভাগ্যে সুধা ওঠে , কারো হলাহল ।
জানি না কেন এ সব , কোন্ ফলাফল
আছে এই বিশ্বব্যাপী কর্মশৃঙ্খলার ।
জানি না কী হবে পরে , সবি অন্ধকার
আদি অন্ত এ সংসারে — নিখিল দুঃখের
অন্ত আছে কি না আছে , সুখ-বুভুক্ষের
মিটে কি না চির-আশা । পণ্ডিতের দ্বারে
চাহি না এ জনমরহস্য জানিবারে ।
চাহি না ছিঁড়িতে একা বিশ্বব্যাপী ডোর ,
লক্ষ কোটি প্রাণী-সাথে এক গতি মোর ।
পরিপূর্ণ এ জীবন , কঠোর বন্ধনে
ক্ষতচিহ্ন পড়ে যায় গ্রনিথতে গ্রনিথতে ,
জানি আমি , সংসারের সমুদ্র মনিথতে
কারো ভাগ্যে সুধা ওঠে , কারো হলাহল ।
জানি না কেন এ সব , কোন্ ফলাফল
আছে এই বিশ্বব্যাপী কর্মশৃঙ্খলার ।
জানি না কী হবে পরে , সবি অন্ধকার
আদি অন্ত এ সংসারে — নিখিল দুঃখের
অন্ত আছে কি না আছে , সুখ-বুভুক্ষের
মিটে কি না চির-আশা । পণ্ডিতের দ্বারে
চাহি না এ জনমরহস্য জানিবারে ।
চাহি না ছিঁড়িতে একা বিশ্বব্যাপী ডোর ,
লক্ষ কোটি প্রাণী-সাথে এক গতি মোর ।
ঝুলন
আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে
মরণখেলা
নিশীথবেলা ।
সঘন বরষা , গগন আঁধার ,
হেরো বারিধারে কাঁদে চারি ধার ,
ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে
ভাসাই ভেলা ;
বাহির হয়েছি স্বপ্ন-শয়ন
করিয়া হেলা
রাত্রিবেলা ।
ওগো , পবনে গগনে সাগরে আজিকে
কী কল্লোল ,
দে দোল্ দোল্ ।
পশ্চাৎ হতে হা হা ক ' রে হাসি
মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি ,
যেন এ লক্ষ যক্ষশিশুর
অট্টরোল ।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে
হট্টগোল ।
দে দোল্ দোল্ ।
আজি জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার
বসিয়া আছে
বুকের কাছে ।
থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া ,
ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া ,
নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে
হৃদয় নাচে ;
ত্রাসে উল্লাসে পরান আমার
ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে ।
হায় , এতকাল আমি রেখেছিনু তারে
যতনভরে
শয়ন ' -পরে ।
ব্যথা পাছে লাগে — দুখ পাছে জাগে
নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
বাসরশয়ন করেছি রচন
কুসুম-থরে ;
দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে
গোপন ঘরে
যতনভরে ।
কত সোহাগ করেছি চুম্বন করি
নয়নপাতে
স্নেহের সাথে ।
শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
কত প্রিয় নাম মৃদু মধুভাষে ,
গুঞ্জরতান করিয়াছি গান
জ্যোৎস্নারাতে ।
যা-কিছু মধুর দিয়েছিনু তার
দুখানি হাতে
স্নেহের সাথে ।
শেষে সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান
আলস-রসে
আবেশবশে ।
পরশ করিলে জাগে না সে আর ,
কুসুমের হার লাগে গুরুভার ,
ঘুমে জাগরণে মিশি একাকার
নিশিদিবসে ।
বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ
মরমে পশে
আবেশবশে ।
ঢালি মধুরে মধুর বধূরে আমার
হারাই বুঝি ,
পাই নে খুঁজি ।
বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে —
ব্যাকুল নয়নে হেরি চারি পাশে
শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম
হয়েছে পুঁজি ।
অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া
মরি যে যুঝি
কাহারে খুঁজি ।
তাই ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে
নূতন খেলা
রাত্রিবেলা ।
মরণদোলায় ধরি রশিগাছি
বসিব দুজনে বড়ো কাছাকাছি ,
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া
মারিবে ঠেলা
আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে
ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা ।
দে দোল্ দোল্ ।
দে দোল্ দোল্ ।
এ মহাসাগরে তুফান তোল্ ।
বধূরে আমার পেয়েছি আবার —
ভরেছে কোল ।
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে
প্রলয়রোল ।
বক্ষ-শোণিতে উঠেছে আবার
কী হিল্লোল!
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার
কী কল্লোল!
উড়ে কুন্তল , উড়ে অঞ্চল ,
উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল ,
বাজে কঙ্কণ বাজে কিঙ্কিণী
মত্ত-বোল ।
দে দোল্ দোল্ ।
আয় রে ঝঞ্ঝা , পরান-বধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর ,
করি লুণ্ঠন অবগুণ্ঠন-
বসন খোল্ ।
দে দোল্ দোল্ ।
প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয়-লাজ ,
বক্ষে বক্ষে পরশিব দোঁহে
ভাবে বিভোল ।
দে দোল্ দোল্ ।
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরেছে আজ
দুটো পাগল ।
দে দোল্ দোল্ ।
তোমরা ও আমরা
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও
কুলুকুলুকল নদীর স্রোতের মতো।
আমরা তীরেতে দাঁড়ায়ে চাহিয়া থাকি,
মরমে গুমরি মরিছে কামনা কত।
আপনা-আপনি কানাকানি কর সুখে,
কৌতুকছটা উছসিছে চোখে মুখে,
কমলচরণ পড়িছে ধরণী-মাঝে,
কনকনূপুর রিনিকি ঝিনিকি বাঝে।
অঙ্গে অঙ্গ বাঁধিছে রঙ্গপাশে,
বাহুতে বাহুতে জড়িত ললিত লতা।
ইঙ্গিতরসে ধ্বনিয়া উঠিছে হাসি,
নয়নে নয়নে বহিছে গোপন কথা।
আঁখি নত করি একেলা গাঁথিছ ফুল,
মুকুর লইয়া যতনে বাঁধিছ চুল।
গোপন হৃদয়ে আপনি করিছ খেলা,
কী কথা ভাবিছ, কেমন কাটিছে বেলা।
চকিতে পলকে অলক উড়িয়া পড়ে,
ঈষৎ হেলিয়া আঁচল মেলিয়া যাও—
নিমেষ ফেলিতে আঁখি না মেলিতে,ত্বরা
নয়নের আড়ে না জানি কাহারে চাও।
যৌবনরাশি টুটিতে লুটিতে চায়,
বসনে শাসনে বাঁধিয়া রেখেছ তায়।
তবু শতবার শতধা হইয়া ফুটে,
চলিতে ফিরিতে ঝলকি চলকি উঠে।
আমরা মূর্খ কহিতে জানি নে কথা,
কী কথা বলিতে কী কথা বলিয়া ফেলি।
অসময়ে গিয়ে লয়ে আপনার মন,
পদতলে দিয়ে চেয়ে থাকি আঁখি মেলি।
তোমরা দেখিয়া চুপি চুপি কথা কও,
সখীতে সখীতে হাসিয়া অধীর হও,
বসন-আঁচল বুকেতে টানিয়া লয়ে
হেসে চলে যাও আশার অতীত হয়ে।
আমরা বৃহৎ অবোধ ঝড়ের মতো
আপন আবেগে ছুটিয়া চলিয়া আসি।
বিপুল আঁধারে অসীম আকাশ ছেয়ে
টুটিবারে চাহি আপন হৃদয়রাশি।
তোমরা বিজুলি হাসিতে হাসিতে চাও,
আঁধার ছেদিয়া মরম বিঁধিয়া দাও,
গগনের গায়ে আগুনের রেখা আঁকি
চকিতে চরণে চলে যাও দিয়ে ফাঁকি।
অযতনে বিধি গড়েছে মোদের দেহ,
নয়ন অধর দেয় নি ভাষায় ভরে।
মোহন মধুর মন্ত্র জানি নে মোরা,
আপনা প্রকাশ করিব কেমন করে?
তোমরা কোথায় আমরা কোথায় আছি,
কোনো সুলগনে হব না কি কাছাকাছি।
তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাবে,
আমরা দাঁড়ায়ে রহিব এমনি ভাবে!
দরিদ্রা
দরিদ্রা
বলিয়া তোরে
বেশি ভালোবাসি
হে ধরিত্রী , স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে—
বেদনাকাতর মুখে সকরুণ হাসি ,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে ।
আপনার বক্ষ হতে রসরক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে ,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে ,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে ।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস ,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে —
স্বর্গ নাই , রচেছিস স্বর্গের আভাস ।
তাই তোর মুখখানি বিষাদকোমল ,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল ।
হে ধরিত্রী , স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে—
বেদনাকাতর মুখে সকরুণ হাসি ,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে ।
আপনার বক্ষ হতে রসরক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে ,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে ,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে ।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস ,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে —
স্বর্গ নাই , রচেছিস স্বর্গের আভাস ।
তাই তোর মুখখানি বিষাদকোমল ,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল ।
দুই পাখি
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে ।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে ,
কী ছিল বিধাতার মনে ।
বনের পাখি বলে , খাঁচার পাখি ভাই ,
বনেতে যাই দোঁহে মিলে ।
খাঁচার পাখি বলে — বনের পাখি , আয়
খাঁচায় থাকি নিরিবিলে । '
বনের পাখি বলে — ‘ না ,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব । '
খাঁচার পাখি বলে — ‘ হায় ,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব! '
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
বনের গান ছিল যত ,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার —
দোঁহার ভাষা দুইমতো ।
বনের পাখি বলে , খাঁচার পাখি ভাই ,
বনের গান গাও দিখি ।
খাঁচার পাখি বলে , বনের পাখি ভাই ,
খাঁচার গান লহো শিখি ।
বনের পাখি বলে — না ,
আমি শিখানো গান নাহি চাই । '
খাঁচার পাখি বলে — ‘ হায় ,
আমি কেমনে বন-গান গাই । '
বনের পাখি বলে , ‘ আকাশ ঘননীল ,
কোথাও বাধা নাহি তার । '
খাঁচার পাখি বলে , ‘ খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারি ধার । '
বনের পাখি বলে , ‘ আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে । '
খাঁচার পাখি বলে , নিরালা সুখকোণে
বাঁধিয়া রাখো আপনারে! '
বনের পাখি বলে — ‘ না ,
সেথা কোথায় উড়িবারে পাই! '
খাঁচার পাখি বলে — ‘ হায় ,
মেঘে কোথায় বসিবার ঠাঁই! '
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
তবুও কাছে নাহি পায় ।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে ,
নীরবে চোখে চোখে চায় ।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে ,
বুঝাতে নারে আপনায় ।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা ,
কাতরে কহে , ‘ কাছে আয়! '
বনের পাখি বলে — না ,
কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার ।
খাঁচার পাখি বলে — হায় ,
মোর শকতি নাহি উড়িবার ।
দুর্বোধ
তুমি মোরে পার না বুঝিতে ?
প্রশান্ত বিষাদভরে
দুটি আঁখি প্রশ্ন ক'রে
অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে ,
চন্দ্রমা যেমন ভাবে স্থিরনতমুখে
চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে ।
কিছু আমি করি নি গোপন ।
যাহা আছে সব আছে
তোমার আঁখির কাছে
প্রসারিত অবারিত মন ।
দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা ,
তাই মোরে বুঝিতে পার না ?
এ যদি হইত শুধু মণি ,
শত খণ্ড করি তারে
সযত্নে বিবিধাকারে
একটি একটি করি গণি
একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার
পরাতেম গলায় তোমার ।
এ যদি হইত শুধু ফুল ,
সুগোল সুন্দর ছোটো ,
উষালোকে ফোটো-ফোটো ,
বসন্তের পবনে দোদুল ,
বৃন্ত হতে সযতনে আনিতাম তুলে —
পরায়ে দিতেম কালো চুলে ।
এ যে সখী , সমস্ত হৃদয় ।
কোথা জল , কোথা কূল ,
দিক হয়ে যায় ভুল ,
অন্তহীন রহস্যনিলয় ।
এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জান রানী —
এ তবু তোমার রাজধানী ।
কী তোমারে চাহি বুঝাইতে ?
গভীর হৃদয়-মাঝে
নাহি জানি কী যে বাজে
নিশিদিন নীরব সংগীতে —
শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন
রজনীর ধ্বনির মতন ।
এ যদি হইত শুধু সুখ ,
কেবল একটি হাসি
অধরের প্রান্তে আসি
আনন্দ করিত জাগরূক ।
মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা ,
বলিতে হত না কোনো কথা ।
এ যদি হইত শুধু দুখ ,
দুটি বিন্দু অশ্রুজল
দুই চক্ষে ছলছল ,
বিষণ্ন অধর , ম্লান মুখ ,
প্রত্যক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যথা ,
নীরবে প্রকাশ হত কথা ।
এ যে সখী , হৃদয়ের প্রেম ,
সুখদুঃখবেদনার
আদি অন্ত নাহি যার —
চিরদৈন্য চিরপূর্ণ হেম ।
নব নব ব্যাকুলতা জাগে দিবারাতে ,
তাই আমি না পারি বুঝাতে ।
নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে!
চিরকাল চোখে চোখে
নূতন নূতনালোকে
পাঠ করো রাত্রি দিন ধরে ।
বুঝা যায় আধো প্রেম , আধখানা মন —
সমস্ত কে বুঝেছে কখন ?
দেউল
রচিয়াছিনু দেউল একখানি
অনেক দিনে অনেক দুখ মানি ।
রাখি নি তার জানালা দ্বার ,
সকল দিক অন্ধকার ,
ভূধর হতে পাষাণভার
যতনে বহি আনি
রচিয়াছিনু দেউল একখানি ।
দেবতাটিরে বসায়ে মাঝখানে
ছিলাম চেয়ে তাহারি মুখপানে ।
বাহিরে ফেলি এ ত্রিভুবন
ভুলিয়া গিয়া বিশ্বজন
ধেয়ান তারি অনুক্ষণ
করেছি একপ্রাণে ,
দেবতাটিরে বসায়ে মাঝখানে ।
যাপন করি অন্তহীন রাতি
জ্বালায়ে শত গন্ধময় বাতি ।
কনকমণি-পাত্রপুটে
সুরভি ধূপধূম্র উঠে ,
গুরু অগুরু-গন্ধ ছুটে ,
পরান উঠে মাতি ।
যাপন করি অন্তহীন রাতি ।
নিদ্রাহীন বসিয়া এক চিতে
চিত্র কত এঁকেছি চারি ভিতে ।
স্বপ্নসম চমৎকার ,
কোথাও নাহি উপমা তার —
কত বরন , কত আকার
কে পারে বরনিতে।
চিত্র যত এঁকেছি চারি ভিতে ।
স্তম্ভগুলি জড়ায়ে শত পাকে
নাগবালিকা ফণা তুলিয়া থাকে ।
উপরে ঘিরি চারিটি ধার
দৈত্যগুলি বিকটাকার ,
পাষাণময় ছাদের ভার
মাথায় ধরি রাখে ।।
নাগবালিকা ফণা তুলিয়া থাকে ।
সৃষ্টিছাড়া সৃজন কত মতো ।
পক্ষীরাজ উড়িছে শত শত ।
ফুলের মতো লতার মাঝে
নারীর মুখ বিকশি রাজে
প্রণয়ভরা বিনয়ে লাজে
নয়ন করি নত ।
সৃষ্টিছাড়া সৃজন কত মতো ।
ধ্বনিত এই ধারার মাঝখানে
শুধু এ গৃহ শব্দ নাহি জানে ।
ব্যাঘ্রাজিন-আসন পাতি
বিবিধরূপ ছন্দ গাঁথি
মন্ত্র পড়ি দিবস রাতি
গুঞ্জরিত তানে ,
শব্দহীন গৃহের মাঝখানে ।
এমন করে গিয়েছে কত দিন ,
জানি নে কিছু , আছি আপন-লীন ।
চিত্ত মোর নিমেষহত
ঊর্ধ্বমুখী শিখার মতো ,
শরীরখানি মূর্ছাহত
ভাবের তাপে ক্ষীণ ।
এমন করে গিয়েছে কত দিন ।
একদা এক বিষম ঘোর স্বরে
বজ্র আসি পড়িল মোর ঘরে ।
বেদনা এক তীক্ষ্মতম
পশিল গিয়ে হৃদয়ে মম ,
অগ্নিময় সর্পসম
কাটিল অন্তরে ।
বজ্র আসি পড়িল মোর ঘরে ।
পাষাণরাশি সহসা গেল টুটি ,
গৃহের মাঝে দিবস উঠে ফুটি ।
নীরব ধ্যান করিয়া চুর
কঠিন বাঁধ করিয়া দূর
সংসারের অশেষ সুর
ভিতরে এল ছুটি ।
পাষাণরাশি সহসা গেল টুটি ।
দেবতা-পানে চাহিনু একবার ,
আলোক আসি পড়েছে মুখে তাঁর ।
নূতন এক মহিমারাশি
ললাটে তাঁর উঠেছে ভাসি ,
জাগিছে এক প্রসাদহাসি
অধর-চারিধার ।
দেবতা-পানে চাহিনু একবার ।
শরমে দীপ মলিন একেবারে
লুকাতে চাহে চির-অন্ধকারে ।
শিকলে বাঁধা স্বপ্নমতো
ভিত্তি-আঁকা চিত্র যত
আলোক দেখি লজ্জাহত
পালাতে নাহি পারে ।
শরমে দীপ মলিন একেবারে ।
যে গান আমি নারিনু রচিবারে
সে গান আজি উঠিল চারি ধারে ।
আমার দীপ জ্বালিল রবি ,
প্রকৃতি আসি আঁকিল ছবি ,
গাঁথিল গান শতেক কবি
কতই ছন্দ-হারে ।
কী গান আজি উঠিল চারি ধারে ।
দেউলে মোর দুয়ার গেল খুলি —
ভিতরে আর বাহিরে কোলাকুলি ,
দেবের করপরশ লাগি
দেবতা মোর উঠিল জাগি ,
বন্দী নিশি গেল সে ভাগি
আঁধার পাখা তুলি ।
দেউলে মোর দুয়ার গেল খুলি ।
নদীপথে
গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে ।
অশনি ঝনঝন
ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে ।
পবন বহে খর বেগে ।
তীরেতে তরুরাজি দোলে
আকুল মর্মর-রোলে ।
চিকুর চিকিমিকে
চকিয়া দিকে দিকে
তিমির চিরি যায় চলে ।
তীরেতে তরুরাজি দোলে ।
ঝরিছে বাদলের ধারা
বিরাম-বিশ্রামহারা ।
বারেক থেমে আসে ,
দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে
আবার পাগলের পারা
ঝরিছে বাদলের ধারা ।
মেঘেতে পথরেখা লীন ,
প্রহর তাই গতিহীন ।
গগন-পানে চাই ,
জানিতে নাহি পাই
গেছে কি নাহি গেছে দিন ;
প্রহর তাই গতিহীন ।
তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী ,
রয়েছি সারা দিন ধরি ।
এখনো পথ নাকি
অনেক আছে বাকি ,
আসিছে ঘোর বিভাবরী ।
তীরেতে বাঁধিয়াছি তরী ।
বসিয়া তরণীর কোণে
একেলা ভাবি মনে মনে —
মেঝেতে শেজ পাতি
সে আজি জাগে রাতি ,
নিদ্রা নাহি দুনয়নে ।
বসিয়া ভাবি মনে মনে ।
মেঘের ডাক শুনে কাঁপে ,
হৃদয় দুই হাতে চাপে ।
আকাশ-পানে চায় ,
ভরসা নাহি পায় ,
তরাসে সারা নিশি যাপে ,
মেঘের ডাক শুনে কাঁপে ।
কভু বা বায়ুবেগভরে
দুয়ার ঝনঝনি পড়ে ।
প্রদীপ নিবে আসে ,
ছায়াটি কাঁপে ত্রাসে ,
নয়নে আঁখিজল ঝরে ,
বক্ষ কাঁপে থরথরে ।
চকিত আঁখি দুটি তার
মনে আসিছে বার বার ।
বাহিরে মহা ঝড় ,
বজ্র কড়মড় ,
আকাশ করে হাহাকার ।
মনে পড়িছে আঁখি তার ।
গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে ।
অশনি ঝনঝন
ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে ।
পবন বহে আজি বেগে ।
নিদ্রিতা
রাজার ছেলে ফিরেছি দেশে দেশে
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
যেখানে যত মধুর মুখ আছে
বাকি তো কিছু রাখি নি দেখিবার।
কেহ বা ডেকে কয়েছে দুটো কথা,
কেহ বা চেয়ে করেছে আঁখি নত,
কাহারো হাসি ছুরির মতো কাটে
কাহারো হাসি আঁখিজলেরই মতো।
গরবে কেহ গিয়েছে নিজ ঘর,
কাঁদিয়া কেহ চেয়েছে ফিরে ফিরে।
কেহ বা কারে কহে নি কোনো কথা,
কেহ বা গান গেয়েছে ধীরে ধীরে।
এমনি করে ফিরেছি দেশে দেশে।
অনেক দূরে তেপান্তর-শেষে
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে এসেছি দিয়ে মালা।
একদা রাতে নবীন যৌবনে
স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,
বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার
ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া।
শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,
পূর্বতটে হতেছে নিশি ভোর।
আকাশ-কোণে বিকাশে জাগরণ,
ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর।
সমুখে পড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
দু-ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,
নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে
আপন মনে ভাবিনু একবার—
আমারি মতো আজি এ নিশিশেষে
ধরার মাঝে নূতন কোন্ দেশে,
দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা
স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা।
অশ্ব চড়ি তখনি বাহিরিনু,
কত যে দেশ-বিদেশ হনু পার।
একদা এক ধূসর সন্ধ্যায়
ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার।
সবাই সেথা অচল অচেতন,
কোথাও জেগে নাইকো জনপ্রাণী,
নদীর তীরে জলের কলতানে
ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি।
ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি,
নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে।
প্রাসাদমাঝে পশিনু সাবধানে,
শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে।
ঘুমায় রাজা, ঘুমায় রানীমাতা,
কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা;
একটি ঘরে রত্নদীপ জ্বালা,
ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা।
কমলফুলবিমল শেজখানি,
নিলীন তাহে কোমল তনুলতা।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।
মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি
শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে;
একটি বাহু বক্ষ-’পরে পড়ি,
একটি বাহু লুটায় এক ধারে।
আঁচলখানি পড়েছে খসি পাশে,
কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি;
পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি।
দেখিনু তারে, উপমা নাহি জানি—
ঘুমের দেশে স্বপন একখানি,
পালঙ্কেতে মগন রাজবালা
আপন ভরা-লাবণ্যে নিরালা।
ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু,
না মানে বাধা হৃদয়কম্পন।
ভূতলে বসি আনত করি শির
মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন।
পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি,
তাহারি পানে চাহিনু একমনে,
দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন
কী আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে।
ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়া
লিখিয়া দিনু আপন নামধাম।
লিখিনু, “অয়ি নিদ্রানিমগনা,
আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম।”
যতন করি কনক-সুতে গাঁথি
রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি।
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
তাহারি গলে পরায়ে দিনু মালা।
নিরুদ্দেশ যাত্রা
আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী ?
বলো কোন্ পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী ।
যখনি শুধাই , ওগো বিদেশিনী ,
তুমি হাস শুধু , মধুরহাসিনী —
বুঝিতে না পারি , কী জানি কী আছে
তোমার মনে ।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি ,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে ।
কী আছে হোথায় — চলেছি কিসের
অন্বেষণে ?
বলো দেখি মোরে , শুধাই তোমায়
অপরিচিতা —
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা ,
ঝলিতেছে জল তরল অনল ,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল ,
দিক্বধূ যেন ছলছল-আঁখি
অশ্রুজলে ,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার ,
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
চরণতলে ?
তুমি হাস শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না ব ' লে ।
হু হু ক ' রে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস ।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন
জলোচ্ছ্বাস ।
সংশয়ময় ঘননীল নীর ,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর ,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন ।
তারি ‘ পরে ভাসে তরণী হিরণ ,
তারি ‘ পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন ?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার
বিলাস হেন ।
যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
‘ কে যাবে সাথে '
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে ।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিম-পানে অসীম সাগর ,
চঞ্চল আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে ।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন ,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে ?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না ব ' লে ।
তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি —
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর , কখনো
শান্ত ছবি ।
বেলা বহে যায় , পালে লাগে বায় —
সোনার তরণী কোথা চলে যায় ,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে ।
এখন বারেক শুধাই তোমায় ,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায় ,
আছে কি শান্তি , আছে কি সুপ্তি
তিমির-তলে ?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না ব ' লে ।
আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা ,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-আলোক
পড়িবে ঢাকা ।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব ,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি ।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর ,
‘ কোথা আছ ওগো করহ পরশ
নিকটে আসি । '
কহিবে না কথা , দেখিতে পাব না
নীরব হাসি ।
পরশপাথর
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।
মাথায় বৃহৎ জটা ধুলায় কাদায় কটা ,
মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর ।
ওষ্ঠে অধরেতে চাপি অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে ।
দুটো নেত্র সদা যেন নিশার খদ্যোত-হেন
উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে ।
নাহি যার চালচুলা গায়ে মাখে ছাইধুলা
কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন ,
ডেকে কথা কয় তারে কেহ নাই এ সংসারে
পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন ,
তার এত অভিমান , সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান ,
রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর ,
দশা দেখে হাসি পায় আর কিছু নাহি চায়
একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!
সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার ।
তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি হেসে হল কুটিকুটি
সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার ।
আকাশ রয়েছে চাহি , নয়নে নিমেষ নাহি ,
হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে পূর্ব গগনের ভালে ,
সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ ।
জলরাশি অবিরল করিতেছে কলকল ,
অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে ।
কাম্য ধন আছে কোথা জানে যেন সব কথা ,
সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে ।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি , মহা গাথা গান গাহি
সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর ।
কেহ যায় , কেহ আসে , কেহ কাঁদে , কেহ হাসে ,
খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।
একদিন , বহুপূর্বে , আছে ইতিহাস —
নিকষে সোনার রেখা সবে যেন দিল দেখা —
আকাশে প্রথম সৃষ্টি পাইল প্রকাশ ।
মিলি যত সুরাসুর কৌতূহলে ভরপুর
এসেছিল পা টিপিয়া এই সিন্ধুতীরে ।
অতলের পানে চাহি নয়নে নিমেষ নাহি
নীরবে দাঁড়ায়ে ছিল স্থির নতশিরে ।
বহুকাল স্তব্ধ থাকি শুনেছিল মুদে আঁখি
এই মহাসমুদ্রের গীতি চিরন্তন ;
তার পরে কৌতূহলে ঝাঁপায়ে অগাধ জলে
করেছিল এ অনন্ত রহস্য মনথন ।
বহুকাল দুঃখ সেবি নিরখিল , লক্ষ্মীদেবী
উদিলা জগৎ-মাঝে অতুল সুন্দর ।
সেই সমুদ্রের তীরে শীর্ণ দেহে জীর্ণ চীরে
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।
এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ ।
খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু বিশ্রাম না জানে কভু ,
আশা গেছে , যায় নাই খোঁজার অভ্যাস ।
বিরহী বিহঙ্গ ডাকে সারা নিশি তরুশাখে ,
যারে ডাকে তার দেখা পায় না অভাগা ।
তবু ডাকে সারাদিন আশাহীন শ্রান্তিহীন ,
একমাত্র কাজ তার ডেকে ডেকে জাগা ।
আর-সব কাজ ভুলি আকাশে তরঙ্গ তুলি
সমুদ্র না জানি কারে চাহে অবিরত ।
যত করে হায় হায় কোনোকালে নাহি পায় ,
তবু শূন্যে তোলে বাহু , ওই তার ব্রত ।
কারে চাহি ব্যোমতলে গ্রহতারা লয়ে চলে ,
অনন্ত সাধনা করে বিশ্বচরাচর ।
সেইমতো সিন্ধুতটে ধূলিমাথা দীর্ঘজটে
খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।
একদা শুধাল তারে গ্রামবাসী ছেলে ,
‘ সন্ন্যাসীঠাকুর , এ কী , কাঁকালে ও কী ও দেখি ,
সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে । '
সন্ন্যাসী চমকি ওঠে শিকল সোনার বটে ,
লোহা সে হয়েছে সোনা জানে না কখন ।
একি কাণ্ড চমৎকার , তুলে দেখে বার বার ,
আঁখি কচালিয়া দেখে এ নহে স্বপন ।
কপালে হানিয়া কর বসে পড়ে ভূমি- ' পর ,
নিজেরে করিতে চাহে নির্দয় লাঞ্ছনা ;
পাগলের মতো চায় — কোথা গেল , হায় হায় ,
ধরা দিয়ে পলাইল সফল বাঞ্ছনা ।
কেবল অভ্যাসমত নুড়ি কুড়াইত কত ,
ঠন্ ক ' রে ঠেকাইত শিকলের ‘ পর ,
চেয়ে দেখিত না , নুড়ি দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি ,
কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশপাথর ।
তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন ।
আকাশ সোনার বর্ণ সমুদ্র গলিত স্বর্ণ ,
পশ্চিমদিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন ।
সন্ন্যাসী আবার ধীরে পূর্বপথে যায় ফিরে
খুঁজিতে নূতন ক ' রে হারানো রতন ।
সে শকতি নাহি আর নুয়ে পড়ে দেহভার
অন্তর লুটায় ছিন্ন তরুর মতন ।
পুরাতন দীর্ঘ পথ পড়ে আছে মৃতবৎ
হেথা হতে কত দূর নাহি তার শেষ ।
দিক হতে দিগন্তরে মরুবালি ধূ ধূ করে ,
আসন্ন রজনী-ছায়ে ম্লান সর্বদেশ ।
অর্ধেক জীবন খুঁজি কোন্ ক্ষণে চক্ষু বুজি
স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর ,
বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ আবার করিছে দান
ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশপাথর ।
সেদিন বরষা ঝরঝর ঝরে
কহিল কবির স্ত্রী
`রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,
তার খোঁজ রাখ কি!
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব—
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম,
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,
না মিলে শস্যকণা।
অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধ’রে এ কি ছেলেখেলা!
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা
লক্ষ্মীর উপাসনা।
ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,
যা করিতে হয় করহ এখনি।
এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি
কিসে কড়ি আসে দুটো!’
দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া
কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া,
পরিহাসছলে ঈষত্ হাসিয়া
কহে জুড়ি করপুট,
`ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে,
লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে,
ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে
এ কথা শুনিবে কেবা!
আমার কপালে বিপরীত ফল—
চপলা লক্ষ্মী মোর অচপল,
ভারতী না থাকে থির এক পল
এতো করি তাঁর সেবা।
তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল
স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল,
আনমনা যদি হই এক-তিল
অমনি সর্বনাশ!’
মনে মনে হাসি মুখ করি ভার
কহে কবিজায়া, `পারি নেকো আর,
ঘরসংসার গেল ছারেখার,
সব তাতে পরিহাস!’
এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি
শিঞ্জিত করি কাঁকন-দুখানি
চঞ্চল করে অঞ্চল টানি
রোষছলে যায় চলি।
হেরি সে ভুবন-গরব-দমন
অভিমানবেগে অধীর গমন
উচাটন কবি কহিল, `অমন
যেয়ো না হৃদয় দলি।
ধরা নাহি দিলে ধরিব দু পায়,
কী করিতে হবে বলো সে উপায়,
ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়—
বুদ্ধি জোগাও তুমি।
একটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই
তোমার মুরতি সেখানে চাপাই,
বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই—
সমস্ত মরুভূমি।’
`হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়’
হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়,
`যেমন বিনয় তেমনি প্রণয়
আমার কপালগুণে।
কথার কখনো ঘটে নি অভাব,
যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব,
একবার ওগো বাক্য-নবাব
চলো দেখি কথা শুনে।
শুভ দিন ক্ষন দেখো পাঁজি খুলি,
সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি,
ক্ষনিকের তরে আলস্য ভুলি
চলো রাজসভা-মাঝে।
আমাদের রাজা গুণীর পালক,
মানুষ হইয়া গেল কত লোক,
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক
লাগিবে কিসের কাজে!’
কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ,
ভাবিল— বিপদ দেখিতেছি আজ,
কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,
কপালে কী জানি আছে!
মুখে হেসে বলে, `এই বৈ নয়!
আমি বলি, আরো কী করিতে হয়!
প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয়
বিধবা হইবে পাছে।
যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ,
ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ—
হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ,
কেয়ূর, কনকহার।
বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে
ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে,
কিঙ্করগণ সাথে যাবে কে কে
আয়োজন করো তার।’
ব্রাহ্মণী কহে, `মুখাগ্রে যার
বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর
মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার
না দেখি আবশ্যক।
নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা
এনেছি পাড়ার করি উপাসনা,
সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা,
রসনা ক্ষান্ত হোক।’
এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ
আনে বেশবাস নানান-ধরন,
কবি ভাবে মুখ করি বিবরন—
আজিকে গতিক মন্দ।
গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া
তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া,
আপনার হাতে যতনে কষিয়া
পরাইল কটিবন্ধ।
উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়,
কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়,
অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়,
কুণ্ডল দেয় কানে।
অঙ্গে যতই চাপায় রতন
কবি বসি থাকে ছবির মতন,
প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন
সেও আজি হার মানে।
এইমতে দুই প্রহর ধরিয়া
বেশভূষা সব সমাধা করিয়া
গৃহিণী নিরখে ঈষত সরিয়া
বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা।
হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ
হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক;
হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবূক,
`আ মরি, সেজেছ কিবা!’
ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া;
কহিল বচন অমিয় ছানিয়া,
`পুরনারীদের পরান হানিয়া
ফিরিয়া আসিবে আজি।
তখন দাসীরে ভুলো না গরবে,
এই উপকার মনে রেখো তবে,
মোরেও এমন পরাইতে হবে
রতনভূষণরাজি।’
কোলের উপরে বসি বাহুপাশে
বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে
কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে
কানে কানে কথা কয়।
দেখিতে দেখিতে কবির অধরে
হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে,
মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে
ফাটিয়া বাহির হয়।
কহে উচ্ছ্বসি, `কিছু না মানিব,
এমনি মধুর শ্লোক বাখানিব
রাজভাণ্ডার টানিয়া আনিব
ও রাঙা চরণতলে!’
বলিতে বলিতে বুক উঠে ফুলি,
উষ্ণীষ-পরা মস্তক তুলি
পথে বাহিরায় গৃহদ্বার খুলি,
দ্রুত রাজগৃহে চলে।
কবির রমণী কুতুহলে ভাসে,
তাড়তাড়ি উঠি বাতায়নপাশে
উঁকি মারি চায়, মনে মনে হাসে—
কালো চোখে আলো নাচে।
কহে মনে মনে বিপুলপুলকে—
রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে,
এমনটি আর পড়িল না চোখে
আমার যেমন আছে॥
এ দিকে কবির উত্সাহ ক্রমে
নিমেষে নিমেষে আসিতেছে কমে,
যখন পশিল নৃপ-আশ্রমে
মরিতে পাইলে বাঁচে।
রাজসভাসদ্ সৈন্য পাহারা
গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা,
সারি সারি দাড়ি করে দিশাহারা—
হেথা কী আসিতে আছে!
হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয়
রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়,
মন্ত্রী হইতে দ্বারীমহাশয়
সবে গম্ভীরমুখ।
মানুষে কেন যে মানুষের প্রতি
ধরি আছে হেন যমের মুরতি
তাই ভাবি কবি না পায় ফুরতি—
দমি যায় তার বুক।
বসি মহারাজ মহেন্দ্ররায়
মহোচ্চ গিরিশিখরের প্রায়,
জন-অরণ্য হেরিছে হেলায়
অচল-অটল ছবি।
কৃপানির্ঝর পড়িছে ঝরিয়া
শত শত দেশ সরস করিয়া,
সে মহামহিমা নয়ন ভরিয়া
চাহিয়া দেখিল কবি।
বিচার সমাধা হল যবে, শেষে
ইঙ্গিত পেয়ে মন্ত্রী-আদেশে
জোড়করপুটে দাঁড়াইল এসে
দেশের প্রধান চর।
অতি সাধুমত আকার প্রকার,
এক-তিল নাহি মুখের বিকার,
ব্যবসা যে তাঁর মানুষ-শিকার
নাহি জানে কোনো নর।
ব্রত নানামত সতত পালয়ে,
এক কানাকড়ি মুল্য না লয়ে
ধর্মোপদেশ আলয়ে আলয়ে
বিতরিছে যাকে তাকে।
চোরা কটাক্ষ চক্ষে ঠিকরে—
কী ঘটিছে কার, কে কোথা কী করে
পাতায় পাতায় শিকড়ে শিকড়ে
সন্ধান তার রাখে।
নামাবলি গায়ে বৈষ্ণবরূপে
যখন সে আসি প্রণমিল ভূপে,
মন্ত্রী রাজারে অতি চুপে চুপে
কী করিল নিবেদন।
অমনি আদেশ হইল রাজার,
`দেহো এঁরে টাকা পঞ্চ হজার।’
`সাধু সাধু’ কহে সভার মাঝার
যত সভাসদ্জন।
পুলক প্রকাশে সবার গাত্রে—
`এ যে দান ইহা যোগ্যপাত্রে,
দেশের আবাল-বনিতা-মাত্রে
ইথে না মানিবে দ্বেষ।’
সাধু নুয়ে পড়ে নম্রতাভরে,
দেখি সভাজন `আহা আহা’ করে,
মন্ত্রীর শুধু জাগিল অধরে
ঈষত্ হাস্যলেশ।
আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধুলিভরা দুটি লইয়া চরণ
চিহ্নিত করি রাজাস্তরণ
পবিত্র পদপঙ্কে।
ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম,
বলি-অঙ্কিত শিথিল চর্ম,
প্রখরমুর্তি অগ্নিশর্ম—
ছাত্র মরে আতঙ্কে।
কোনো দিকে কোনো লক্ষ না ক’রে
পড়ি গেল শ্লোক বিকট হাঁ ক’রে,
মটর কড়াই মিশায়ে কাঁকরে
চিবাইল যেন দাঁতে।
কেহ তার নাহি বুঝে আগুপিছু,
সবে বসি থাকে মাথা করি নিচু;
রাজা বলে, `এঁরে দক্ষিণা কিছু
দাও দক্ষিণ হাতে।’
তার পরে এল গনত্কার,
গণনায় রাজা চমত্কার,
টাকা ঝন্ ঝন্ ঝনত্কার
বাজায়ে সে গেল চলি।
আসে এক বুড়ো গণ্যমান্য
করপুটে লয়ে দুর্বাধান্য,
রাজা তাঁর প্রতি অতি বদান্য
ভরিয়া দিলেন থলি।
আসে নট ভাট রাজপুরোহিত—
কেহ একা কেহ শিষ্য-সহিত,
কারো বা মাথায় পাগড়ি লোহিত
কারো বা হরিত্বর্ণ।
আসে দ্বিজগণ পরমারাধ্য—
কন্যার দায়, পিতার শ্রাদ্ধ—
যার যথামত পায় বরাদ্দ;
রাজা আজি দাতাকর্ণ।
যে যাহার সবে যায় স্বভবনে,
কবি কী করিবে ভাবে মনে মনে,
রাজা দেখে তারে সভাগৃহকোণে
বিপন্নমুখছবি।
কহে ভূপ, `হোথা বসিয়া কে ওই,
এস তো, মন্ত্রী, সন্ধান লই।’
কবি কহি উঠে, `আমি কেহ নই,
আমি শুধু এক কবি।’
রাজা কহে, `বটে! এসো এসো তবে,
আজিকে কাব্য-আলোচনা হবে।’
বসাইলা কাছে মহাগৌরবে
ধরি তার কর দুটি।
মন্ত্রী ভাবিল, যাই এই বেলা,
এখন তো শুরু হবে ছেলেখেলা—
কহে, `মহারাজ, কাজ আছে মেলা,
আদেশ পাইলে উঠি।’
রাজা শুধু মৃদু নাড়িলা হস্ত,
নৃপ-ইঙ্গিতে মহা তটস্থ
বাহির হইয়া গেল সমস্ত
সভাস্থ দলবল—
পাত্র মিত্র অমাত্য আদি,
অর্থী প্রার্থী বাদী প্রতিবাদী,
উচ্চ তুচ্ছ বিবিধ-উপাধি
বন্যার যেন জল॥
চলি গেল যবে সভ্যসুজন
মুখোমুখি করি বসিলা দুজন;
রাজা বলে, `এবে কাব্যকূজন
আরম্ভ করো কবি।’
কবি তবে দুই কর জুড়ি বুকে
বাণীবন্দনা করে নত মুখে,
`প্রকাশো জননী নয়নসমুখে
প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
উদাসীন আনমনা।
চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
পেয়েছি স্বরগসুধা।
সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি,
তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী—
সুরের খাদ্যে জানো তো মা, বাণী,
নরের মিটে না ক্ষুধা।
যা হবার হবে সে কথা ভাবি না,
মা গো, একবার ঝংকারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনী
অমৃত-উত্স-ধারা।
যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিনমর্ত-মাঝে বহমান
নিয়ত আত্মহারা।
যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া
হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া,
অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া
বিশ্বতন্ত্রী হতে।
যে রাগিণী চিরজন্ম ধরিয়া
চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া—
অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া
ছুটে সহস্র স্রোতে।
কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়,
নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়—
বালুকার’পরে কালের বেলায়
ছায়া-আলোকের খেলা।
জগতের যত রাজা মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ,
সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ—
টুটিছে সন্ধ্যাবেলা।
শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর
বিপুল বৃহত্ গভীর মধুর,
চিরদিন তাহে আছে ভরপুর
মগন গগনতল।
যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি
ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী—
জানে না আপনা, জানে না ধরণী,
সংসারকোলাহল।
সে জন পাগল, পরান বিকল—
ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল
কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল,
ঠেকেছে চরণে তব।
তোমার অমল কমলগন্ধ
হৃদয়ে ঢালিছে মহা-আনন্দ—
অপূর্ব গীত, আলোক ছন্দ
শুনিছ নিত্য নব।
বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী—
বারেকের তরে ভুলাও, জননী,
কে বড়ো কে ছোটো, কে দীন কে ধনী,
কেবা আগে কেবা পিছে—
কার জয় হল কার পরাজয়,
কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়,
কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়,
কে উপরে কেবা নীচে।
গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে
ছোটো জগতের ছোটোবড়ো সবে,
সুখে প’ড়ে রবে পদপল্লবে
যেন মালা একখানি।
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি
বীণা হাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালের পান্থ যাহারা
তব সংগীতস্রোতে।
দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল
ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল,
দশ দিক্বধূ খুলি কেশজাল
নাচে দশ দিক হতে।’
এতেক বলিয়া ক্ষণপরে কবি
করুণ কথায় প্রকাশিল ছবি
পূণ্যকাহিনী রঘুকুলরবি
রাঘবের ইতিহাস।
অসহ দুঃখ সহি নিরবধি
কেমনে জনম গিয়েছে দগধি,
জীবনের শেষ দিবস অবধি
অসীম নিরাশ্বাস।
কহিল, `বারেক ভাবি দেখো মনে
সেই একদিন কেটেছে কেমনে
যেদিন মলিন বাকলবসনে
চলিলা বনের পথে—
ভাই লক্ষ্মণ বয়স নবীন,
ম্লানছায়াসম বিষাদবিলীন
নববধূ সীতা আভরণহীন
উঠিলা বিদায়রথে।
রাজপুরী-মাঝে উঠে হাহাকার,
প্রজা কাঁদিতেছে পথে সারে-সার,
এমন বজ্র কখনো কি আর
পড়েছে এমন ঘরে!
অভিষেক হবে, উত্সবে তার
আনন্দময় ছিল চারি ধার—
মঙ্গলদীপ নিবিয়া আঁধার
শুধু নিমেষের ঝড়ে।
আর-একদিন, ভেবে দেখো মনে,
যেদিন শ্রীরাম লয়ে লক্ষ্মণে
ফিরিয়া নিভৃত কুটিরভবনে
দেখিলা জানকী নাহি—
`জানকী’ `জানকী’ আর্ত রোদনে
ডাকিয়া ফিরিলা কাননে কাননে,
মহা-অরণ্য আঁধার-আননে
রহিল নীরবে চাহি।
তার পরে দেখো শেষ কোথা এর,
ভেবে দেখো কথা সেই দিবসের—
এত বিষাদের এত বিরহের
এত সাধনার ধন,
সেই সীতাদেবী রাজসভা-মাঝে
বিদায়বিনয়ে নমি রঘুরাজে
দ্বিধা ধরাতলে অভিমানে লাজে
হইলা অদর্শন।
সে-সকল দিন সেও চলে যায়,
সে অসহ শোক— চিহ্ন কোথায়—
যায় নি তো এঁকে ধরণীর গায়
অসীম দগ্ধরেখা।
দ্বিধা ধরাভুমি জুড়েছে আবার,
দণ্ডকবনে ফুটে ফুলভার,
সরযূর কূলে দুলে তৃণসার
প্রফুল্লশ্যামলেখা।
শুধু সে দিনের একখানি সুর
চিরদিন ধ’রে বহু বহু দূর
কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর
মধুর করুণ তানে।
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসংগীতে
বাজে মানবের কানে।’
তার পরে কবি কহিল সে কথা,
কুরুপাণ্ডবসমরবারতা—
গৃহবিবাদের ঘোর মত্ততা
ব্যাপিল সর্ব দেশ;
দুইটি যমজ তরু পাশাপাশি,
ঘর্ষণে জ্বলে হুতাশনরাশি,
মহাদাবানল ফেলে শেষে গ্রাসি
অরণ্যপরিবেশ।
এক গিরি হতে দুই-স্রোত-পারা
দুইটি শীর্ণ বিদ্বেষধারা
সরীসৃপগতি মিলিল তাহারা
নিষ্ঠুর অভিমানে,
দেখিতে দেখিতে হল উপনীত
ভারতের যত ক্ষত্রশোণিত—
ত্রাসিত ধরণী করিল ধ্বনিত
প্রলয়বন্যাগানে।
দেখিতে দেখিতে ডুবে গেল কূল,
আত্ম ও পর হয়ে গেল ভুল,
গৃহবন্ধন করি নির্মূল
ছুটিল রক্তধারা—
ফেনায়ে উঠিল মরণাম্বুধি,
বিশ্ব রহিল নিশ্বাস রুধি
কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি
নিবায়ে সূর্যতারা।
সমরবন্যা যবে অবসান
সোনার ভারত বিপুল শ্মশান,
রাজগৃহ যত ভূতলশয়ান
পড়ে আছে ঠাঁই ঠাঁই।
ভীষণা শান্তি রক্তনয়নে
বসিয়া শোণিতপঙ্কশয়নে,
চাহি ধরা-পানে আনতবয়নে
মুখেতে বচন নাই।
বহু দিন পরে ঘুচিয়াছে খেদ,
মরণে মিটেছে সব বিচ্ছেদ,
সমাধা যজ্ঞ মহা-নরমেধ
বিদ্বেষহুতাশনে।
সকল কামনা করিয়া পূর্ণ
সকল দম্ভ করিয়া চূর্ণ
পাঁচ ভাই গিয়া বসিলা শূন্য
স্বর্ণসিংহাসনে।
স্তব্ধ প্রাসাদ বিষাদ-আঁধার,
শ্মশান হইতে আসে হাহাকার
রাজপুরবধূ যত অনাথার
মর্মবিদার রব।
`জয় জয় জয় পাণ্ডুতনয়’
সারি সারি দ্বারী দাঁড়াইয়া কয়—
পরিহাস বলে আজ মনে হয়,
মিছে মনে হয় সব।
কালি যে ভারত সারা দিন ধরি
অট্ট গরজে অম্বর ভরি
রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি
ছাড়ি কুলভয়লাজে,
পরদিনে চিতাভস্ম মাখিয়া
সন্ন্যাসীবেশে অঙ্গ ঢাকিয়া
বসি একাকিনী শোকার্তহিয়া
শূন্যশ্মশানমাঝে।
কুরুপাণ্ডব মুছে গেছে সব,
সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব,
সে চিতাবহ্নি অতি ভৈরব
ভস্মও নাহি তার।
যে ভূমি লইয়া এত হানাহানি
সে আজি কাহার তাহাও না জানি,
কোথা ছিল রাজা কোথা রাজধানী
চিহ্ন নাহিকো আর।
তবু কোথা হতে আসিছে সে স্বর—
যেন সে অমর সমরসাগর
গ্রহণ করেছে নব কলেবর
একটি বিরাট গানে।
বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ,
সফল আশার বিষাদ মহান্,
উদাস শান্তি করিতেছে দান
চিরমানবের প্রাণে।
হায়, এ ধরায় কত অনন্ত
বরষে বরষে শীত বসন্ত
সুখে দুখে ভরি দিক্-দিগন্ত
হাসিয়া গিয়াছে ভাসি।
এমনি বরষা আজিকার মতো
কতদিন কত হয়ে গেছে গত,
নবমেঘভারে গগন আনত
ফেলেছে অশ্রুরাশি।
যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে,
দুখিরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে,
প্রেমিক যেজন ভালো সে বেসেছে
আজি আমাদেরই মতো;
তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান
দু হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান—
দেশে দেশে তার নাহি পরিমাণ,
ভেসে ভেসে যায় কত।
শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে,
সমস্ত প্রাণে কেন-যে কে জানে
ভরে আসে আঁখিজল—
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা,
লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা
সুন্দর ধরাতল!
এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ
চাহি নে করিতে বাদ প্রতিবাদ,
যে ক’ দিন আছি মানসের সাধ
মিটাব আপন-মনে—
যার যাহা আছে তার থাক্ তাই,
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই
একটি নিভৃত কোণে।
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি,
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মত সংগীতগুলি
ফুটাই আকাশভালে।
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসারধুলিজালে।
অতিদুর্গম সৃষ্টিশিখরে
অসীম কালের মহাকন্দরে
সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে
ঝর্ঝরসংগীতে,
স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা
ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশহারা—
সেথা হতে টানি লব গীতধারা
ছোটো এই বাঁশরিতে।
ধরণীর শ্যাম করপুটখানি
ভরি দিব আমি সেই গীত আনি,
বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী
মধুর-অর্থ-ভরা।
নবীন আষাঢ়ে রচি নব মায়া
এঁকে দিয়ে যাব ঘনতর ছায়া,
করে দিয়ে যাব বসন্তকায়া
বাসন্তীবাস-পরা।
ধরণীর তলে গগনের গায়
সাগরের জলে অরণ্যছায়
আরেকটুখানি নবীন আভায়
রঙিন করিয়া দিব।
সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে
শিশিরের মত রবে।
না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে—
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
মাগিছে তেমনি সুর।
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা
রেখে যাব সুমধুর।
থাকো হৃদাসনে জননী ভারতী—
তোমারি চরণে প্রাণের আরতি,
চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি,
রাখি না কাহারো আশা।
কত সুখ ছিল হয়ে গেছে দুখ,
কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ,
ম্লান হয়ে গেছে কত উত্সুক
উন্মুখ ভালোবাসা।
শুধু ও চরণ হৃদয়ে বিরাজে,
শুধু ওই বীণা চিরদিন বাজে,
স্নেহসুরে ডাকে অন্তর-মাঝে—
আয় রে বত্স, আয়,
ফেলে রেখে আয় হাসি ক্রন্দন,
ছিঁড়ে আয় যত মিছে বন্ধন,
হেথা ছায়া আছে চিরনন্দন
চিরবসন্ত-বায়।
সেই ভালো মা গো, যাক যাহা যায়,
জন্মের মত বরিনু তোমায়—
কমলগন্ধ কোমল দু পায়
বার বার নমোনম।’
এত বলি কবি থামাইল গান,
বসিয়া রহিল মুগ্ধনয়ান,
বাজিতে লাগিল হৃদয় পরান
বীণাঝংকার-সম।
পুলকিত রাজা, আঁখি ছলছল্,
আসন ছাড়িয়া নামিলা ভূতল—
দু বাহু বাড়ায়ে, পরান উতল,
কবিরে লইলা বুকে।
কহিলা `ধন্য, কবি গো, ধন্য,
আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন,
তোমারে কী আমি কহিব অন্য—
চিরদিন থাকো সুখে।
ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে,
করি পরিতোষ কোন্ উপহারে,
যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে
সব দিতে পারি আনি।’
প্রেমোচ্ছ্বসিত আনন্দজলে
ভরি দু নয়ন কবি তাঁরে বলে,
`কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে
ওই ফুলমালাখানি।’
মালা বাঁধি কেশে কবি যায় পথে,
কেহ শিবিকায় কেহ ধায় রথে,
নানা দিকে লোক যায় নানামতে
কাজের অন্বেষণে।
কবি নিজমনে ফিরিছে লুব্ধ,
যেন সে তাহার নয়ন মুগ্ধ
কল্পধেনুর অমৃতদুগ্ধ
দোহন করিছে মনে।
কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ
সন্ধ্যার মতো পরি রাঙা বাস
বসি একাকিনী বাতায়ন-পাশ—
সুখহাস মুখে ফুটে।
কপোতের দল চারি দিকে ঘিরে
নাচিয়া ডাকিয়া বেড়াইছে ফিরে—
যবের কণিকা তুলিয়া সে ধীরে
দিতেছে চঞ্চুপুটে।
অঙ্গুলি তার চলিছে যেমন
কত কী-যে কথা ভাবিতেছে মন,
হেনকালে পথে ফেলিয়া নয়ন
সহসা কবিরে হেরি
বাহুখানি নাড়ি মৃদু ঝিনিঝিনি
বাজাইয়া দিল করকিঙ্কিণী,
হাসিজালখানি অতুলহাসিনী
ফেলিলা কবিরে ঘেরি।
কবির চিত্ত উঠে উল্লাসি;
অতি সত্বর সম্মুখে আসি
কহে কৌতুকে মৃদু মৃদু হাসি,
`দেখো কী এনেছি বালা!
নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন,
আমি আনিয়াছি করিয়া যতন
তোমার কণ্ঠে দেবার মতন
রাজকণ্ঠের মালা।’
এত বলি মালা শির হতে খুলি
প্রিয়ার গলায় দিতে গেল তুলি,
কবিনারী রোষে কর দিল ঠেলি
ফিরায়ে রহিল মুখ।
মিছে ছল করি মুখে করে রাগ,
মনে মনে তার জাগিছে সোহাগ,
গরবে ভরিয়া উঠে অনুরাগ,
হৃদয়ে উথলে সুখ।
কবি ভাবে বিধি অপ্রসন্ন,
বিপদ আজিকে হেরি আসন্ন
বসি থাকে মুখ করি বিষণ্ণ
শূন্যে নয়ন মেলি।
কবির ললনা আধখানি বেঁকে
চোরা কটাক্ষে চাহে থেকে থেকে,
পতির মুখের ভাবখানা দেখে
মুখের বসন ফেলি
উচ্চকণ্ঠে উঠিল হাসিয়া,
তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া,
চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া
পড়িল তাহার বুকে।
সেথায় লুকায়ে হাসিয়া কাঁদিয়া
কবির কণ্ঠ বাহুতে বাঁধিয়া
শতবার করি আপনি সাধিয়া
চুম্বিল তার মুখে।
বিস্মিত কবি বিহ্বলপ্রায়
আনন্দে কথা খুঁজিয়া না পায়,
মালাখানি লয়ে আপন গলায়
আদরে পরিলা সতী।
ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে
চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে—
বাঁধা প’ল এক মাল্যবাঁধনে
লক্ষ্মীসরস্বতী॥
কহিল কবির স্ত্রী
`রাশি রাশি মিল করিয়াছ জড়ো,
রচিতেছ বসি পুঁথি বড়ো বড়ো,
মাথার উপরে বাড়ি পড়ো-পড়ো,
তার খোঁজ রাখ কি!
গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব—
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম,
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব,
না মিলে শস্যকণা।
অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,
নিশিদিন ধ’রে এ কি ছেলেখেলা!
ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা
লক্ষ্মীর উপাসনা।
ওগো, ফেলে দাও পুঁথি ও লেখনী,
যা করিতে হয় করহ এখনি।
এত শিখিয়াছ এটুকু শেখ নি
কিসে কড়ি আসে দুটো!’
দেখি সে মুরতি সর্বনাশিয়া
কবির পরান উঠিল ত্রাসিয়া,
পরিহাসছলে ঈষত্ হাসিয়া
কহে জুড়ি করপুট,
`ভয় নাহি করি ও মুখ-নাড়ারে,
লক্ষ্মী সদয় লক্ষ্মীছাড়ারে,
ঘরেতে আছেন নাইকো ভাঁড়ারে
এ কথা শুনিবে কেবা!
আমার কপালে বিপরীত ফল—
চপলা লক্ষ্মী মোর অচপল,
ভারতী না থাকে থির এক পল
এতো করি তাঁর সেবা।
তাই তো কপাটে লাগাইয়া খিল
স্বর্গে মর্তে খুঁজিতেছি মিল,
আনমনা যদি হই এক-তিল
অমনি সর্বনাশ!’
মনে মনে হাসি মুখ করি ভার
কহে কবিজায়া, `পারি নেকো আর,
ঘরসংসার গেল ছারেখার,
সব তাতে পরিহাস!’
এতেক বলিয়া বাঁকায়ে মুখানি
শিঞ্জিত করি কাঁকন-দুখানি
চঞ্চল করে অঞ্চল টানি
রোষছলে যায় চলি।
হেরি সে ভুবন-গরব-দমন
অভিমানবেগে অধীর গমন
উচাটন কবি কহিল, `অমন
যেয়ো না হৃদয় দলি।
ধরা নাহি দিলে ধরিব দু পায়,
কী করিতে হবে বলো সে উপায়,
ঘর ভরি দিব সোনায় রুপায়—
বুদ্ধি জোগাও তুমি।
একটুকু ফাঁকা যেখানে যা পাই
তোমার মুরতি সেখানে চাপাই,
বুদ্ধির চাষ কোনোখানে নাই—
সমস্ত মরুভূমি।’
`হয়েছে, হয়েছে, এত ভালো নয়’
হাসিয়া রুষিয়া গৃহিণী ভনয়,
`যেমন বিনয় তেমনি প্রণয়
আমার কপালগুণে।
কথার কখনো ঘটে নি অভাব,
যখনি বলেছি পেয়েছি জবাব,
একবার ওগো বাক্য-নবাব
চলো দেখি কথা শুনে।
শুভ দিন ক্ষন দেখো পাঁজি খুলি,
সঙ্গে করিয়া লহো পুঁথিগুলি,
ক্ষনিকের তরে আলস্য ভুলি
চলো রাজসভা-মাঝে।
আমাদের রাজা গুণীর পালক,
মানুষ হইয়া গেল কত লোক,
ঘরে তুমি জমা করিলে শোলোক
লাগিবে কিসের কাজে!’
কবির মাথায় ভাঙি পড়ে বাজ,
ভাবিল— বিপদ দেখিতেছি আজ,
কখনো জানি নে রাজা মহারাজ,
কপালে কী জানি আছে!
মুখে হেসে বলে, `এই বৈ নয়!
আমি বলি, আরো কী করিতে হয়!
প্রাণ দিতে পারি, শুধু জাগে ভয়
বিধবা হইবে পাছে।
যেতে যদি হয় দেরিতে কী কাজ,
ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ—
হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ,
কেয়ূর, কনকহার।
বলে দাও মোর সারথিরে ডেকে
ঘোড়া বেছে নেয় ভালো ভালো দেখে,
কিঙ্করগণ সাথে যাবে কে কে
আয়োজন করো তার।’
ব্রাহ্মণী কহে, `মুখাগ্রে যার
বাধে না কিছুই, কী চাহে সে আর
মুখ ছুটাইলে রথাশ্বে তার
না দেখি আবশ্যক।
নানা বেশভূষা হীরা রুপা সোনা
এনেছি পাড়ার করি উপাসনা,
সাজ করে লও পুরায়ে বাসনা,
রসনা ক্ষান্ত হোক।’
এতেক বলিয়া ত্বরিতচরণ
আনে বেশবাস নানান-ধরন,
কবি ভাবে মুখ করি বিবরন—
আজিকে গতিক মন্দ।
গৃহিণী স্বয়ং নিকটে বসিয়া
তুলিল তাহারে মাজিয়া ঘষিয়া,
আপনার হাতে যতনে কষিয়া
পরাইল কটিবন্ধ।
উষ্ণীষ আনি মাথায় চড়ায়,
কণ্ঠী আনিয়া কণ্ঠে জড়ায়,
অঙ্গদ দুটি বাহুতে পরায়,
কুণ্ডল দেয় কানে।
অঙ্গে যতই চাপায় রতন
কবি বসি থাকে ছবির মতন,
প্রেয়সীর নিজ হাতের যতন
সেও আজি হার মানে।
এইমতে দুই প্রহর ধরিয়া
বেশভূষা সব সমাধা করিয়া
গৃহিণী নিরখে ঈষত সরিয়া
বাঁকায়ে মধুর গ্রীবা।
হেরিয়া কবির গম্ভীর মুখ
হৃদয়ে উপজে মহা কৌতুক;
হাসি উঠি কহে ধরিয়া চিবূক,
`আ মরি, সেজেছ কিবা!’
ধরিল সমুখে আরশি আনিয়া;
কহিল বচন অমিয় ছানিয়া,
`পুরনারীদের পরান হানিয়া
ফিরিয়া আসিবে আজি।
তখন দাসীরে ভুলো না গরবে,
এই উপকার মনে রেখো তবে,
মোরেও এমন পরাইতে হবে
রতনভূষণরাজি।’
কোলের উপরে বসি বাহুপাশে
বাঁধিয়া কবিরে সোহাগে সহাসে
কপোল রাখিয়া কপোলের পাশে
কানে কানে কথা কয়।
দেখিতে দেখিতে কবির অধরে
হাসিরাশি আর কিছুতে না ধরে,
মুগ্ধ হৃদয় গলিয়া আদরে
ফাটিয়া বাহির হয়।
কহে উচ্ছ্বসি, `কিছু না মানিব,
এমনি মধুর শ্লোক বাখানিব
রাজভাণ্ডার টানিয়া আনিব
ও রাঙা চরণতলে!’
বলিতে বলিতে বুক উঠে ফুলি,
উষ্ণীষ-পরা মস্তক তুলি
পথে বাহিরায় গৃহদ্বার খুলি,
দ্রুত রাজগৃহে চলে।
কবির রমণী কুতুহলে ভাসে,
তাড়তাড়ি উঠি বাতায়নপাশে
উঁকি মারি চায়, মনে মনে হাসে—
কালো চোখে আলো নাচে।
কহে মনে মনে বিপুলপুলকে—
রাজপথ দিয়ে চলে এত লোকে,
এমনটি আর পড়িল না চোখে
আমার যেমন আছে॥
এ দিকে কবির উত্সাহ ক্রমে
নিমেষে নিমেষে আসিতেছে কমে,
যখন পশিল নৃপ-আশ্রমে
মরিতে পাইলে বাঁচে।
রাজসভাসদ্ সৈন্য পাহারা
গৃহিণীর মতো নহে তো তাহারা,
সারি সারি দাড়ি করে দিশাহারা—
হেথা কী আসিতে আছে!
হেসে ভালোবেসে দুটো কথা কয়
রাজসভাগৃহ হেন ঠাঁই নয়,
মন্ত্রী হইতে দ্বারীমহাশয়
সবে গম্ভীরমুখ।
মানুষে কেন যে মানুষের প্রতি
ধরি আছে হেন যমের মুরতি
তাই ভাবি কবি না পায় ফুরতি—
দমি যায় তার বুক।
বসি মহারাজ মহেন্দ্ররায়
মহোচ্চ গিরিশিখরের প্রায়,
জন-অরণ্য হেরিছে হেলায়
অচল-অটল ছবি।
কৃপানির্ঝর পড়িছে ঝরিয়া
শত শত দেশ সরস করিয়া,
সে মহামহিমা নয়ন ভরিয়া
চাহিয়া দেখিল কবি।
বিচার সমাধা হল যবে, শেষে
ইঙ্গিত পেয়ে মন্ত্রী-আদেশে
জোড়করপুটে দাঁড়াইল এসে
দেশের প্রধান চর।
অতি সাধুমত আকার প্রকার,
এক-তিল নাহি মুখের বিকার,
ব্যবসা যে তাঁর মানুষ-শিকার
নাহি জানে কোনো নর।
ব্রত নানামত সতত পালয়ে,
এক কানাকড়ি মুল্য না লয়ে
ধর্মোপদেশ আলয়ে আলয়ে
বিতরিছে যাকে তাকে।
চোরা কটাক্ষ চক্ষে ঠিকরে—
কী ঘটিছে কার, কে কোথা কী করে
পাতায় পাতায় শিকড়ে শিকড়ে
সন্ধান তার রাখে।
নামাবলি গায়ে বৈষ্ণবরূপে
যখন সে আসি প্রণমিল ভূপে,
মন্ত্রী রাজারে অতি চুপে চুপে
কী করিল নিবেদন।
অমনি আদেশ হইল রাজার,
`দেহো এঁরে টাকা পঞ্চ হজার।’
`সাধু সাধু’ কহে সভার মাঝার
যত সভাসদ্জন।
পুলক প্রকাশে সবার গাত্রে—
`এ যে দান ইহা যোগ্যপাত্রে,
দেশের আবাল-বনিতা-মাত্রে
ইথে না মানিবে দ্বেষ।’
সাধু নুয়ে পড়ে নম্রতাভরে,
দেখি সভাজন `আহা আহা’ করে,
মন্ত্রীর শুধু জাগিল অধরে
ঈষত্ হাস্যলেশ।
আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধুলিভরা দুটি লইয়া চরণ
চিহ্নিত করি রাজাস্তরণ
পবিত্র পদপঙ্কে।
ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম,
বলি-অঙ্কিত শিথিল চর্ম,
প্রখরমুর্তি অগ্নিশর্ম—
ছাত্র মরে আতঙ্কে।
কোনো দিকে কোনো লক্ষ না ক’রে
পড়ি গেল শ্লোক বিকট হাঁ ক’রে,
মটর কড়াই মিশায়ে কাঁকরে
চিবাইল যেন দাঁতে।
কেহ তার নাহি বুঝে আগুপিছু,
সবে বসি থাকে মাথা করি নিচু;
রাজা বলে, `এঁরে দক্ষিণা কিছু
দাও দক্ষিণ হাতে।’
তার পরে এল গনত্কার,
গণনায় রাজা চমত্কার,
টাকা ঝন্ ঝন্ ঝনত্কার
বাজায়ে সে গেল চলি।
আসে এক বুড়ো গণ্যমান্য
করপুটে লয়ে দুর্বাধান্য,
রাজা তাঁর প্রতি অতি বদান্য
ভরিয়া দিলেন থলি।
আসে নট ভাট রাজপুরোহিত—
কেহ একা কেহ শিষ্য-সহিত,
কারো বা মাথায় পাগড়ি লোহিত
কারো বা হরিত্বর্ণ।
আসে দ্বিজগণ পরমারাধ্য—
কন্যার দায়, পিতার শ্রাদ্ধ—
যার যথামত পায় বরাদ্দ;
রাজা আজি দাতাকর্ণ।
যে যাহার সবে যায় স্বভবনে,
কবি কী করিবে ভাবে মনে মনে,
রাজা দেখে তারে সভাগৃহকোণে
বিপন্নমুখছবি।
কহে ভূপ, `হোথা বসিয়া কে ওই,
এস তো, মন্ত্রী, সন্ধান লই।’
কবি কহি উঠে, `আমি কেহ নই,
আমি শুধু এক কবি।’
রাজা কহে, `বটে! এসো এসো তবে,
আজিকে কাব্য-আলোচনা হবে।’
বসাইলা কাছে মহাগৌরবে
ধরি তার কর দুটি।
মন্ত্রী ভাবিল, যাই এই বেলা,
এখন তো শুরু হবে ছেলেখেলা—
কহে, `মহারাজ, কাজ আছে মেলা,
আদেশ পাইলে উঠি।’
রাজা শুধু মৃদু নাড়িলা হস্ত,
নৃপ-ইঙ্গিতে মহা তটস্থ
বাহির হইয়া গেল সমস্ত
সভাস্থ দলবল—
পাত্র মিত্র অমাত্য আদি,
অর্থী প্রার্থী বাদী প্রতিবাদী,
উচ্চ তুচ্ছ বিবিধ-উপাধি
বন্যার যেন জল॥
চলি গেল যবে সভ্যসুজন
মুখোমুখি করি বসিলা দুজন;
রাজা বলে, `এবে কাব্যকূজন
আরম্ভ করো কবি।’
কবি তবে দুই কর জুড়ি বুকে
বাণীবন্দনা করে নত মুখে,
`প্রকাশো জননী নয়নসমুখে
প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
উদাসীন আনমনা।
চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
পেয়েছি স্বরগসুধা।
সেই মোর ভালো, সেই বহু মানি,
তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী—
সুরের খাদ্যে জানো তো মা, বাণী,
নরের মিটে না ক্ষুধা।
যা হবার হবে সে কথা ভাবি না,
মা গো, একবার ঝংকারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনী
অমৃত-উত্স-ধারা।
যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিনমর্ত-মাঝে বহমান
নিয়ত আত্মহারা।
যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া
হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া,
অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া
বিশ্বতন্ত্রী হতে।
যে রাগিণী চিরজন্ম ধরিয়া
চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া—
অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া
ছুটে সহস্র স্রোতে।
কে আছে কোথায়, কে আসে কে যায়,
নিমেষে প্রকাশে, নিমেষে মিলায়—
বালুকার’পরে কালের বেলায়
ছায়া-আলোকের খেলা।
জগতের যত রাজা মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ,
সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ—
টুটিছে সন্ধ্যাবেলা।
শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর
বিপুল বৃহত্ গভীর মধুর,
চিরদিন তাহে আছে ভরপুর
মগন গগনতল।
যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি
ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী—
জানে না আপনা, জানে না ধরণী,
সংসারকোলাহল।
সে জন পাগল, পরান বিকল—
ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল
কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল,
ঠেকেছে চরণে তব।
তোমার অমল কমলগন্ধ
হৃদয়ে ঢালিছে মহা-আনন্দ—
অপূর্ব গীত, আলোক ছন্দ
শুনিছ নিত্য নব।
বাজুক সে বীণা, মজুক ধরণী—
বারেকের তরে ভুলাও, জননী,
কে বড়ো কে ছোটো, কে দীন কে ধনী,
কেবা আগে কেবা পিছে—
কার জয় হল কার পরাজয়,
কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়,
কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়,
কে উপরে কেবা নীচে।
গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে
ছোটো জগতের ছোটোবড়ো সবে,
সুখে প’ড়ে রবে পদপল্লবে
যেন মালা একখানি।
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি
বীণা হাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালের পান্থ যাহারা
তব সংগীতস্রোতে।
দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল
ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল,
দশ দিক্বধূ খুলি কেশজাল
নাচে দশ দিক হতে।’
এতেক বলিয়া ক্ষণপরে কবি
করুণ কথায় প্রকাশিল ছবি
পূণ্যকাহিনী রঘুকুলরবি
রাঘবের ইতিহাস।
অসহ দুঃখ সহি নিরবধি
কেমনে জনম গিয়েছে দগধি,
জীবনের শেষ দিবস অবধি
অসীম নিরাশ্বাস।
কহিল, `বারেক ভাবি দেখো মনে
সেই একদিন কেটেছে কেমনে
যেদিন মলিন বাকলবসনে
চলিলা বনের পথে—
ভাই লক্ষ্মণ বয়স নবীন,
ম্লানছায়াসম বিষাদবিলীন
নববধূ সীতা আভরণহীন
উঠিলা বিদায়রথে।
রাজপুরী-মাঝে উঠে হাহাকার,
প্রজা কাঁদিতেছে পথে সারে-সার,
এমন বজ্র কখনো কি আর
পড়েছে এমন ঘরে!
অভিষেক হবে, উত্সবে তার
আনন্দময় ছিল চারি ধার—
মঙ্গলদীপ নিবিয়া আঁধার
শুধু নিমেষের ঝড়ে।
আর-একদিন, ভেবে দেখো মনে,
যেদিন শ্রীরাম লয়ে লক্ষ্মণে
ফিরিয়া নিভৃত কুটিরভবনে
দেখিলা জানকী নাহি—
`জানকী’ `জানকী’ আর্ত রোদনে
ডাকিয়া ফিরিলা কাননে কাননে,
মহা-অরণ্য আঁধার-আননে
রহিল নীরবে চাহি।
তার পরে দেখো শেষ কোথা এর,
ভেবে দেখো কথা সেই দিবসের—
এত বিষাদের এত বিরহের
এত সাধনার ধন,
সেই সীতাদেবী রাজসভা-মাঝে
বিদায়বিনয়ে নমি রঘুরাজে
দ্বিধা ধরাতলে অভিমানে লাজে
হইলা অদর্শন।
সে-সকল দিন সেও চলে যায়,
সে অসহ শোক— চিহ্ন কোথায়—
যায় নি তো এঁকে ধরণীর গায়
অসীম দগ্ধরেখা।
দ্বিধা ধরাভুমি জুড়েছে আবার,
দণ্ডকবনে ফুটে ফুলভার,
সরযূর কূলে দুলে তৃণসার
প্রফুল্লশ্যামলেখা।
শুধু সে দিনের একখানি সুর
চিরদিন ধ’রে বহু বহু দূর
কাঁদিয়া হৃদয় করিছে বিধুর
মধুর করুণ তানে।
সে মহাপ্রাণের মাঝখানটিতে
যে মহারাগিণী আছিল ধ্বনিতে
আজিও সে গীত মহাসংগীতে
বাজে মানবের কানে।’
তার পরে কবি কহিল সে কথা,
কুরুপাণ্ডবসমরবারতা—
গৃহবিবাদের ঘোর মত্ততা
ব্যাপিল সর্ব দেশ;
দুইটি যমজ তরু পাশাপাশি,
ঘর্ষণে জ্বলে হুতাশনরাশি,
মহাদাবানল ফেলে শেষে গ্রাসি
অরণ্যপরিবেশ।
এক গিরি হতে দুই-স্রোত-পারা
দুইটি শীর্ণ বিদ্বেষধারা
সরীসৃপগতি মিলিল তাহারা
নিষ্ঠুর অভিমানে,
দেখিতে দেখিতে হল উপনীত
ভারতের যত ক্ষত্রশোণিত—
ত্রাসিত ধরণী করিল ধ্বনিত
প্রলয়বন্যাগানে।
দেখিতে দেখিতে ডুবে গেল কূল,
আত্ম ও পর হয়ে গেল ভুল,
গৃহবন্ধন করি নির্মূল
ছুটিল রক্তধারা—
ফেনায়ে উঠিল মরণাম্বুধি,
বিশ্ব রহিল নিশ্বাস রুধি
কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি
নিবায়ে সূর্যতারা।
সমরবন্যা যবে অবসান
সোনার ভারত বিপুল শ্মশান,
রাজগৃহ যত ভূতলশয়ান
পড়ে আছে ঠাঁই ঠাঁই।
ভীষণা শান্তি রক্তনয়নে
বসিয়া শোণিতপঙ্কশয়নে,
চাহি ধরা-পানে আনতবয়নে
মুখেতে বচন নাই।
বহু দিন পরে ঘুচিয়াছে খেদ,
মরণে মিটেছে সব বিচ্ছেদ,
সমাধা যজ্ঞ মহা-নরমেধ
বিদ্বেষহুতাশনে।
সকল কামনা করিয়া পূর্ণ
সকল দম্ভ করিয়া চূর্ণ
পাঁচ ভাই গিয়া বসিলা শূন্য
স্বর্ণসিংহাসনে।
স্তব্ধ প্রাসাদ বিষাদ-আঁধার,
শ্মশান হইতে আসে হাহাকার
রাজপুরবধূ যত অনাথার
মর্মবিদার রব।
`জয় জয় জয় পাণ্ডুতনয়’
সারি সারি দ্বারী দাঁড়াইয়া কয়—
পরিহাস বলে আজ মনে হয়,
মিছে মনে হয় সব।
কালি যে ভারত সারা দিন ধরি
অট্ট গরজে অম্বর ভরি
রাজার রক্তে খেলেছিল হোরি
ছাড়ি কুলভয়লাজে,
পরদিনে চিতাভস্ম মাখিয়া
সন্ন্যাসীবেশে অঙ্গ ঢাকিয়া
বসি একাকিনী শোকার্তহিয়া
শূন্যশ্মশানমাঝে।
কুরুপাণ্ডব মুছে গেছে সব,
সে রণরঙ্গ হয়েছে নীরব,
সে চিতাবহ্নি অতি ভৈরব
ভস্মও নাহি তার।
যে ভূমি লইয়া এত হানাহানি
সে আজি কাহার তাহাও না জানি,
কোথা ছিল রাজা কোথা রাজধানী
চিহ্ন নাহিকো আর।
তবু কোথা হতে আসিছে সে স্বর—
যেন সে অমর সমরসাগর
গ্রহণ করেছে নব কলেবর
একটি বিরাট গানে।
বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ,
সফল আশার বিষাদ মহান্,
উদাস শান্তি করিতেছে দান
চিরমানবের প্রাণে।
হায়, এ ধরায় কত অনন্ত
বরষে বরষে শীত বসন্ত
সুখে দুখে ভরি দিক্-দিগন্ত
হাসিয়া গিয়াছে ভাসি।
এমনি বরষা আজিকার মতো
কতদিন কত হয়ে গেছে গত,
নবমেঘভারে গগন আনত
ফেলেছে অশ্রুরাশি।
যুগে যুগে লোক গিয়েছে এসেছে,
দুখিরা কেঁদেছে, সুখীরা হেসেছে,
প্রেমিক যেজন ভালো সে বেসেছে
আজি আমাদেরই মতো;
তারা গেছে, শুধু তাহাদের গান
দু হাতে ছড়ায়ে করে গেছে দান—
দেশে দেশে তার নাহি পরিমাণ,
ভেসে ভেসে যায় কত।
শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে,
সমস্ত প্রাণে কেন-যে কে জানে
ভরে আসে আঁখিজল—
বহু মানবের প্রেম দিয়ে ঢাকা,
বহু দিবসের সুখে দুখে আঁকা,
লক্ষ যুগের সংগীতে মাখা
সুন্দর ধরাতল!
এ ধরার মাঝে তুলিয়া নিনাদ
চাহি নে করিতে বাদ প্রতিবাদ,
যে ক’ দিন আছি মানসের সাধ
মিটাব আপন-মনে—
যার যাহা আছে তার থাক্ তাই,
কারো অধিকারে যেতে নাহি চাই
শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই
একটি নিভৃত কোণে।
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি,
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মত সংগীতগুলি
ফুটাই আকাশভালে।
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসারধুলিজালে।
অতিদুর্গম সৃষ্টিশিখরে
অসীম কালের মহাকন্দরে
সতত বিশ্বনির্ঝর ঝরে
ঝর্ঝরসংগীতে,
স্বরতরঙ্গ যত গ্রহতারা
ছুটিছে শূন্যে উদ্দেশহারা—
সেথা হতে টানি লব গীতধারা
ছোটো এই বাঁশরিতে।
ধরণীর শ্যাম করপুটখানি
ভরি দিব আমি সেই গীত আনি,
বাতাসে মিশায়ে দিব এক বাণী
মধুর-অর্থ-ভরা।
নবীন আষাঢ়ে রচি নব মায়া
এঁকে দিয়ে যাব ঘনতর ছায়া,
করে দিয়ে যাব বসন্তকায়া
বাসন্তীবাস-পরা।
ধরণীর তলে গগনের গায়
সাগরের জলে অরণ্যছায়
আরেকটুখানি নবীন আভায়
রঙিন করিয়া দিব।
সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে
শিশিরের মত রবে।
না পারে বুঝাতে, আপনি না বুঝে
মানুষ ফিরিছে কথা খুঁজে খুঁজে—
কোকিল যেমন পঞ্চমে কূজে
মাগিছে তেমনি সুর।
কিছু ঘুচাইব সেই ব্যাকুলতা,
কিছু মিটাইব প্রকাশের ব্যথা,
বিদায়ের আগে দু-চারিটা কথা
রেখে যাব সুমধুর।
থাকো হৃদাসনে জননী ভারতী—
তোমারি চরণে প্রাণের আরতি,
চাহি না চাহিতে আর কারো প্রতি,
রাখি না কাহারো আশা।
কত সুখ ছিল হয়ে গেছে দুখ,
কত বান্ধব হয়েছে বিমুখ,
ম্লান হয়ে গেছে কত উত্সুক
উন্মুখ ভালোবাসা।
শুধু ও চরণ হৃদয়ে বিরাজে,
শুধু ওই বীণা চিরদিন বাজে,
স্নেহসুরে ডাকে অন্তর-মাঝে—
আয় রে বত্স, আয়,
ফেলে রেখে আয় হাসি ক্রন্দন,
ছিঁড়ে আয় যত মিছে বন্ধন,
হেথা ছায়া আছে চিরনন্দন
চিরবসন্ত-বায়।
সেই ভালো মা গো, যাক যাহা যায়,
জন্মের মত বরিনু তোমায়—
কমলগন্ধ কোমল দু পায়
বার বার নমোনম।’
এত বলি কবি থামাইল গান,
বসিয়া রহিল মুগ্ধনয়ান,
বাজিতে লাগিল হৃদয় পরান
বীণাঝংকার-সম।
পুলকিত রাজা, আঁখি ছলছল্,
আসন ছাড়িয়া নামিলা ভূতল—
দু বাহু বাড়ায়ে, পরান উতল,
কবিরে লইলা বুকে।
কহিলা `ধন্য, কবি গো, ধন্য,
আনন্দে মন সমাচ্ছন্ন,
তোমারে কী আমি কহিব অন্য—
চিরদিন থাকো সুখে।
ভাবিয়া না পাই কী দিব তোমারে,
করি পরিতোষ কোন্ উপহারে,
যাহা-কিছু আছে রাজভাণ্ডারে
সব দিতে পারি আনি।’
প্রেমোচ্ছ্বসিত আনন্দজলে
ভরি দু নয়ন কবি তাঁরে বলে,
`কণ্ঠ হইতে দেহো মোর গলে
ওই ফুলমালাখানি।’
মালা বাঁধি কেশে কবি যায় পথে,
কেহ শিবিকায় কেহ ধায় রথে,
নানা দিকে লোক যায় নানামতে
কাজের অন্বেষণে।
কবি নিজমনে ফিরিছে লুব্ধ,
যেন সে তাহার নয়ন মুগ্ধ
কল্পধেনুর অমৃতদুগ্ধ
দোহন করিছে মনে।
কবির রমণী বাঁধি কেশপাশ
সন্ধ্যার মতো পরি রাঙা বাস
বসি একাকিনী বাতায়ন-পাশ—
সুখহাস মুখে ফুটে।
কপোতের দল চারি দিকে ঘিরে
নাচিয়া ডাকিয়া বেড়াইছে ফিরে—
যবের কণিকা তুলিয়া সে ধীরে
দিতেছে চঞ্চুপুটে।
অঙ্গুলি তার চলিছে যেমন
কত কী-যে কথা ভাবিতেছে মন,
হেনকালে পথে ফেলিয়া নয়ন
সহসা কবিরে হেরি
বাহুখানি নাড়ি মৃদু ঝিনিঝিনি
বাজাইয়া দিল করকিঙ্কিণী,
হাসিজালখানি অতুলহাসিনী
ফেলিলা কবিরে ঘেরি।
কবির চিত্ত উঠে উল্লাসি;
অতি সত্বর সম্মুখে আসি
কহে কৌতুকে মৃদু মৃদু হাসি,
`দেখো কী এনেছি বালা!
নানা লোকে নানা পেয়েছে রতন,
আমি আনিয়াছি করিয়া যতন
তোমার কণ্ঠে দেবার মতন
রাজকণ্ঠের মালা।’
এত বলি মালা শির হতে খুলি
প্রিয়ার গলায় দিতে গেল তুলি,
কবিনারী রোষে কর দিল ঠেলি
ফিরায়ে রহিল মুখ।
মিছে ছল করি মুখে করে রাগ,
মনে মনে তার জাগিছে সোহাগ,
গরবে ভরিয়া উঠে অনুরাগ,
হৃদয়ে উথলে সুখ।
কবি ভাবে বিধি অপ্রসন্ন,
বিপদ আজিকে হেরি আসন্ন
বসি থাকে মুখ করি বিষণ্ণ
শূন্যে নয়ন মেলি।
কবির ললনা আধখানি বেঁকে
চোরা কটাক্ষে চাহে থেকে থেকে,
পতির মুখের ভাবখানা দেখে
মুখের বসন ফেলি
উচ্চকণ্ঠে উঠিল হাসিয়া,
তুচ্ছ ছলনা গেল সে ভাসিয়া,
চকিতে সরিয়া নিকটে আসিয়া
পড়িল তাহার বুকে।
সেথায় লুকায়ে হাসিয়া কাঁদিয়া
কবির কণ্ঠ বাহুতে বাঁধিয়া
শতবার করি আপনি সাধিয়া
চুম্বিল তার মুখে।
বিস্মিত কবি বিহ্বলপ্রায়
আনন্দে কথা খুঁজিয়া না পায়,
মালাখানি লয়ে আপন গলায়
আদরে পরিলা সতী।
ভক্তি-আবেগে কবি ভাবে মনে
চেয়ে সেই প্রেমপূর্ণ বদনে—
বাঁধা প’ল এক মাল্যবাঁধনে
লক্ষ্মীসরস্বতী॥
————-
শাহাজাদপুর
১৩ শ্রাবণ ১৩০০
শাহাজাদপুর
১৩ শ্রাবণ ১৩০০
প্রতীক্ষা
ওরে মৃত্যু , জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে
বেঁধেছিস বাসা ।
যেখানে নির্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর
স্নেহ-ভালোবাসা ,
গোপন মনের আশা , জীবনের দুঃখ সুখ ,
মর্মের বেদনা ,
চিরদিবসের যত হাসি-অশ্রু-চিহ্ন-আঁকা
বাসনা-সাধনা ;
যেখানে নন্দন-ছায়ে নিঃশঙ্কে করিছে খেলা
অন্তরের ধন ,
স্নেহের পুত্তলিগুলি , আজন্মের স্নেহস্মৃতি ,
আনন্দকিরণ ;
কত আলো , কত ছায়া , কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের
গীতিময়ী ভাষা —
ওরে মৃত্যু , জানিয়াছি , তারি মাঝখানে এসে
বেঁধেছিস বাসা!
নিশিদিন নিরন্তর জগৎ জুড়িয়া খেলা ,
জীবন চঞ্চল ।
চেয়ে দেখি রাজপথে চলেছে অশ্রান্তগতি
যত পানথদল ;
রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে পাখিগুলি উড়ে যায়
প্রাণপূর্ণ বেগে ,
সমীরকম্পিত বনে নিশিশেষে নব নব
পুষ্প উঠে জেগে ;
চারি দিকে কত শত দেখাশোনা আনাগোনা
প্রভাতে সন্ধ্যায় ;
দিনগুলি প্রতি প্রাতে খুলিতেছে জীবনের
নূতন অধ্যায় ;
তুমি শুধু এক প্রান্তে বসে আছ অহর্নিশি
স্তব্ধ নেত্র খুলি —
মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা উঠ পক্ষ ঝাপটিয়া ,
বক্ষ উঠে দুলি ।
যে সুদূর সমুদ্রের পরপার-রাজ্য হতে
আসিয়াছ হেথা ,
এনেছ কি সেথাকার নূতন সংবাদ কিছু
গোপন বারতা ।
সেথা শব্দহীন তীরে ঊর্মিগুলি তালে তালে
মহামন্দ্রে বাজে ,
সেই ধ্বনি কী করিয়া ধ্বনিয়া তুলিছ মোর
ক্ষুদ্র বক্ষোমাঝে ।
রাত্রি দিন ধুক ধুক হৃদয়পঞ্জর-তটে
অনন্তের ঢেউ ,
অবিশ্রাম বাজিতেছে সুগম্ভীর সমতানে
শুনিছে না কেউ ।
আমার এ হৃদয়ের ছোটোখাটো গীতগুলি ,
স্নেহ-কলরব ,
তারি মাঝে কে আনিল দিশাহীন সমুদ্রের
সংগীত ভৈরব ।
তুই কি বাসিস ভালো আমার এ বক্ষোবাসী
পরান-পক্ষীরে ,
তাই এর পার্শ্বে এসে কাছে বসেছিস ঘেঁষে
অতি ধীরে ধীরে ?
দিনরাত্রি নির্নিমেষে চাহিয়া নেত্রের পানে
নীরব সাধনা ,
নিস্তব্ধ আসনে বসি একাগ্র আগ্রহভরে
রুদ্র আরাধনা ।
চপল চঞ্চল প্রিয়া ধরা নাহি দিতে চায় ,
স্থির নাহি থাকে ,
মেলি নানাবর্ণ পাখা উড়ে উড়ে চলে যায়
নব নব শাখে ;
তুই তবু একমনে মৌনব্রত একাসনে
বসি নিরলস ।
ক্রমে সে পড়িবে ধরা , গীত বন্ধ হয়ে যাবে
মানিবে সে বশ ।
তখন কোথায় তারে ভুলায়ে লইয়া যাবি —
কোন্ শূন্যপথে ,
অচৈতন্য প্রেয়সীরে অবহেলে লয়ে কোলে
অন্ধকার রথে!
যেথায় অনাদি রাত্রি রয়েছে চিরকুমারী —
আলোক-পরশ
একটি রোমা ' রেখা আঁকে নি তাহার গাত্রে
অসংখ্য বরষ ;
সৃজনের পরপ্রান্তে যে অনন্ত অন্তঃপুরে
কভু দৈববশে
দূরতম জ্যোতিষ্কের ক্ষীণতম পদধ্বনি
তিল নাহি পশে ,
সেথায় বিরাট পক্ষ দিবি তুই বিস্তারিয়া
বন্ধনবিহীন ,
কাঁপিবে বক্ষের কাছে নবপরিণীতা বধূ
নূতন স্বাধীন ।
ক্রমে সে কি ভুলে যাবে ধরণীর নীড়খানি
তৃণে পত্রে গাঁথা —
এ আনন্দ-সূর্যালোক , এই স্নেহ , এই গেহ ,
এই পুষ্পপাতা ?
ক্রমে সে প্রণয়ভরে তোরেও কি করে লবে
আত্মীয় স্বজন ,
অন্ধকার বাসরেতে হবে কি দুজনে মিলি
মৌন আলাপন ।
তোর স্নিগ্ধ সুগম্ভীর অচঞ্চল প্রেমমূর্তি ,
অসীম নির্ভর ,
নির্নিমেষ নীল নেত্র , বিশ্বব্যাপ্ত জটাজূট ,
নির্বাক অধর —
তার কাছে পৃথিবীর চঞ্চল আনন্দগুলি
তুচ্ছ মনে হবে ;
সমুদ্রে মিশিলে নদী বিচিত্র তটের স্মৃতি
স্মরণে কি রবে ?
ওগো মৃত্যু , ওগো প্রিয় , তবু থাক্ কিছুকাল
ভুবনমাঝারে ।
এরি মাঝে বধূবেশে অনন্তবাসর-দেশে
লইয়ো না তারে ।
এখনো সকল গান করে নি সে সমাপন
সন্ধ্যায় প্রভাতে ;
নিজের বক্ষের তাপে মধুর উত্তপ্ত নীড়ে
সুপ্ত আছে রাতে ;
পানথপাখিদের সাথে এখনো যে যেতে হবে
নব নব দেশে ,
সিন্ধুতীরে , কুঞ্জবনে নব নব বসন্তের
আনন্দ-উদ্দেশে ।
ওগো মৃত্যু , কেন তুই এখনি তাহার নীড়ে
বসেছিস এসে ?
তার সব ভালোবাসা আঁধার করিতে চাস
তুই ভালোবেসে ?
এ যদি সত্যই হয় মৃত্তিকার পৃথ্বী- ' পরে
মুহূর্তের খেলা ,
এই সব মুখোমুখি এই সব দেখাশোনা
ক্ষণিকের মেলা ,
প্রাণপণ ভালোবাসা সেও যদি হয় শুধু
মিথ্যার বন্ধন ,
পরশে খসিয়া পড়ে , তার পরে দণ্ড-দুই
অরণ্যে ক্রন্দন —
তুমি শুধু চিরস্থায়ী , তুমি শুধু সীমাশূন্য
মহাপরিণাম ,
যত আশা যত প্রেম তোমার তিমিরে লভে
অনন্ত বিশ্রাম —
তবে মৃত্যু , দূরে যাও , এখনি দিয়ো না ভেঙে
এ খেলার পুরী ;
ক্ষণেক বিলম্ব করো , আমার দুদিন হতে
করিয়ো না চুরি ।
একদা নামিবে সন্ধ্যা , বাজিবে আরতিশঙ্খ
অদূর মন্দিরে ,
বিহঙ্গ নীরব হবে , উঠিবে ঝিল্লির ধ্বনি
অরণ্য-গভীরে ,
সমাপ্ত হইবে কর্ম , সংসার-সংগ্রাম-শেষে
জয়পরাজয় ,
আসিবে তন্দ্রার ঘোর পান্থের নয়ন ' -পরে
ক্লান্ত অতিশয় ,
দিনান্তের শেষ আলো দিগন্তে মিলায়ে যাবে ,
ধরণী আঁধার —
সুদূরে জ্বলিবে শুধু অনন্তের যাত্রাপথে
প্রদীপ তারার ,
শিয়রে শয়ন-শেষে বসি যারা অনিমেষে
তাহাদের চোখে
আসিবে শ্রান্তির ভার নিদ্রাহীন যামিনীতে
স্তিমিত আলোকে —
একে একে চলে যাবে আপন আলয়ে সবে
সখাতে সখীতে ,
তৈলহীন দীপশিখা নিবিয়া আসিবে ক্রমে
অর্ধরজনীতে ,
উচ্ছ্বসিত সমীরণ আনিবে সুগন্ধ বহি
অদৃশ্য ফুলের ,
অন্ধকার পূর্ণ করি আসিবে তরঙ্গধ্বনি
অজ্ঞাত কূলের —
ওগো মৃত্যু , সেই লগ্নে নির্জন শয়নপ্রান্তে
এসো বরবেশে ।
আমার পরান-বধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া
বহু ভালোবেসে
ধরিবে তোমার বাহু ; তখন তাহারে তুমি
মন্ত্র পড়ি নিয়ো ,
রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বন দানে
পাণ্ডু করি দিয়ো ।
প্রত্যাখান
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
অমন সুধা-করুণ সুরে
গেয়ো না ।
সকালবেলা সকল কাজে
আসিতে যেতে পথের মাঝে
আমারি এই আঙিনা দিয়ে
যেয়ো না ।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
মনের কথা রেখেছি মনে
যতনে ,
ফিরিছ মিছে মাগিয়া সেই
রতনে ।
তুচ্ছ অতি , কিছু সে নয় ,
দু চারি ফোঁটা অশ্রু ময়
একটি শুধু শোণিত-রাঙা
বেদনা ।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
কাহার আশে দুয়ারে কর
হানিছ ?
না জানি তুমি কী মোরে মনে
মানিছ!
রয়েছি হেথা লুকাতে লাজ ,
নাহিকো মোর রানীর সাজ ,
পরিয়া আছি জীর্ণচীর
বাসনা ।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
কী ধন তুমি এনেছ ভরি
দু হাতে ।
অমন করি যেয়ো না ফেলি
ধুলাতে ।
এ ঋণ যদি শুধিতে চাই
কী আছে হেন , কোথায় পাই —
জনম-তরে বিকাতে হবে
আপনা ।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
ভেবেছি মনে , ঘরের কোণে
রহিব ।
গোপন দুখ আপন বুকে
বহিব ।
কিসের লাগি করিব আশা ,
বলিতে চাহি , নাহিকো ভাষা —
রয়েছে সাধ , না জানি তার
সাধনা ।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
যে-সুর তুমি ভরেছ তব
বাঁশিতে
উহার সাথে আমি কি পারি
গাহিতে ?
গাহিতে গেলে ভাঙিয়া গান
উছলি উঠে সকল প্রাণ ,
না মানে রোধ অতি অবোধ
রোদনা ।
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
এসেছ তুমি গলায় মালা
ধরিয়া —
নবীন বেশ , শোভন ভূষা
পরিয়া ।
হেথায় কোথা কনক-থালা ,
কোথায় ফুল , কোথায় মালা —
বাসরসেবা করিবে কে বা
রচনা ?
অমন দীননয়নে তুমি
চেয়ো না ।
ভুলিয়া পথ এসেছ , সখা ,
এ ঘরে ।
অন্ধকারে মালা-বদল
কে করে!
সন্ধ্যা হতে কঠিন ভুঁয়ে
একাকী আমি রয়েছি শুয়ে ,
নিবায়ে দীপ জীবননিশি
যাপনা!
অমন দীননয়নে আর
চেয়ো না ।
২৭ আষাঢ় ১৩০০
বন্ধন
বন্ধন
? বন্ধন বটে
, সকলি বন্ধন
—
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা ; সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে লইতেছে টানি ,
নব নব রসস্রোতে পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান । স্তন্যের পিপাসা
কল্যাণদায়িনীরূপে থাকে শিশুমুখে —
তেমনি সহজ তৃষ্ণা আশা ভালোবাসা
সমস্ত বিশ্বের রস কত সুখে দুখে
করিতেছে আকর্ষণ , জনমে জনমে
প্রাণে মনে পূর্ণ করি গঠিতেছে ক্রমে
দুর্লভ জীবন ; পলে পলে নব আশ
নিয়ে যায় নব নব আস্বাদে আশ্রমে ।
স্তন্যতৃষ্ণা নষ্ট করি মাতৃবন্ধপাশ
ছিন্ন করিবারে চাস কোন্ মুক্তিভ্রমে!
স্নেহ প্রেম সুখতৃষ্ণা ; সে যে মাতৃপাণি
স্তন হতে স্তনান্তরে লইতেছে টানি ,
নব নব রসস্রোতে পূর্ণ করি মন
সদা করাইছে পান । স্তন্যের পিপাসা
কল্যাণদায়িনীরূপে থাকে শিশুমুখে —
তেমনি সহজ তৃষ্ণা আশা ভালোবাসা
সমস্ত বিশ্বের রস কত সুখে দুখে
করিতেছে আকর্ষণ , জনমে জনমে
প্রাণে মনে পূর্ণ করি গঠিতেছে ক্রমে
দুর্লভ জীবন ; পলে পলে নব আশ
নিয়ে যায় নব নব আস্বাদে আশ্রমে ।
স্তন্যতৃষ্ণা নষ্ট করি মাতৃবন্ধপাশ
ছিন্ন করিবারে চাস কোন্ মুক্তিভ্রমে!
বর্ষাযাপন
রাজধানী কলিকাতা; তেতালার ছাতে
কাঠের কুঠরি এক ধারে;
আলো আসে পূর্ব দিকে প্রথম প্রভাতে,
বায়ু আসে দক্ষিণের দ্বারে।
মেঝেতে বিছানা পাতা, দুয়ারে রাখিয়া মাথা
বাহিরে আঁখিরে দিই ছুটি,
সৌধ-ছাদ শত শত ঢাকিয়া রহস্য কত
আকাশেরে করিছে ভ্রূকুটি।
নিকটে জানালা-গায় এক কোণে আলিসায়
একটুকু সবুজের খেলা,
শিশু অশথের গাছ আপন ছায়ার নাচ
সারা দিন দেখিছে একেলা।
দিগন্তের চারি পাশে আষাঢ় নামিয়া আসে,
বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো,
সমস্ত আকাশজোড়া গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া
চিকমিকে বিদ্যুতের আলো।
চারি দিকে অবিরল ঝরঝর বৃষ্টিজল
এই ছোটো প্রান্ত-ঘরটিরে
দেয় নির্বাসিত করি দশ দিক অপহরি
সমুদয় বিশ্বের বাহিরে।
বসে বসে সঙ্গীহীন ভালো লাগে কিছুদিন
পড়িবারে মেঘদূতকথা—
বাহিরে দিবস রাতি বায়ু করে মাতামাতি
বহিয়া বিফল ব্যাকুলতা;
বহুপূর্ব আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন ভারতের
নগ-নদী-নগরী বাহিয়া
কত শ্রুতিমধু নাম কত দেশ কত গ্রাম
দেখে যাই চাহিয়া চাহিয়া।
ভালো করে দোঁহে চিনি, বিরহী ও বিরহিণী
জগতের দু পারে দুজন—
প্রাণে প্রাণে পড়ে টান, মাঝে মহা ব্যবধান,
মনে মনে কল্পনা সৃজন।
যক্ষবধূ গৃহকোণে ফুল নিয়ে দিন গণে
দেখে শুনে ফিরে আসি চলি।
বর্ষা আসে ঘন রোলে, যত্নে টেনে লই কোলে
গোবিন্দদাসের পদাবলী।
সুর করে বার বার পড়ি বর্ষা-অভিসার—
অন্ধকার যমুনার তীর,
নিশীথে নবীনা রাধা নাহি মানে কোনো বাধা,
খুঁজিতেছে নিকুঞ্জ-কুটির।
অনুক্ষণ দর দর বারি ঝরে ঝর ঝর,
তাহে অতি দূরতর বন;
ঘরে ঘরে রুদ্ধ দ্বার, সঙ্গে কেহ নাহি আর
শুধু এক কিশোর মদন।
আষাঢ় হতেছে শেষ, মিশায়ে মল্লার দেশ
রচি 'ভরা বাদরের' সুর।
খুলিয়া প্রথম পাতা, গীতগোবিন্দের গাথা
গাহি 'মেঘে অম্বর মেদুর'।
স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঝুপ্ ঝুপ্ বৃষ্টি পড়ে—
শুয়ে শুয়ে সুখ-অনিদ্রায়
‘রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন’
সেই গান মনে পড়ে যায়।
‘পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে’
মনসুখে নিদ্রায় মগন—
সেই ছবি জাগে মনে পুরাতন বৃন্দাবনে
রাধিকার নির্জন স্বপন।
মৃদু মৃদু বহে শ্বাস, অধরে লাগিছে হাস,
কেঁপে উঠে মুদিত পলক;
বাহুতে মাথাটি থুয়ে একাকিনী আছে শুয়ে,
গৃহকোণে ম্লান দীপালোক।
গিরিশিরে মেঘ ডাকে, বৃষ্টি ঝরে তরুশাখে
দাদুরী ডাকিছে সারারাতি—
হেনকালে কী না ঘটে, এ সময়ে আসে বটে
একা ঘরে স্বপনের সাথি।
মরি মরি স্বপ্নশেষে পুলকিত রসাবেশে
যখন সে জাগিল একাকী,
দেখিল বিজন ঘরে দীপ নিবু নিবু করে
প্রহরী প্রহর গেল হাঁকি।
বাড়িছে বৃষ্টির বেগ, থেকে থেকে ডাকে মেঘ,
ঝিল্লিরব পৃথিবী ব্যাপিয়া,
সেই ঘনঘোরা নিশি স্বপ্নে জাগরণে মিশি
না জানি কেমন করে হিয়া।
লয়ে পুঁথি দু-চারিটি নেড়ে চেড়ে ইটি সিটি
এইমতো কাটে দিনরাত।
তার পরে টানি লই বিদেশী কাব্যের বই,
উলটি পালটি দেখি পাত—
কোথা রে বর্ষার ছায়া অন্ধকার মেঘমায়া
ঝরঝর ধ্বনি অহরহ,
কোথায় সে কর্মহীন একান্তে আপনে-লীন
জীবনের নিগূঢ় বিরহ!
বর্ষার সমান সুরে অন্তর বাহির পুরে
সংগীতের মুষলধারায়,
পরানের বহুদূর কূলে কূলে ভরপুর,
বিদেশী কাব্যে সে কোথা হায়!
তখন সে পুঁথি ফেলি, দুয়ারে আসন মেলি
বসি গিয়ে আপনার মনে,
কিছু করিবার নাই চেয়ে চেয়ে ভাবি তাই
দীর্ঘ দিন কাটিবে কেমনে।
মাথাটি করিয়া নিচু বসে বসে রচি কিছু
বহু যত্নে সারাদিন ধরে—
ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল—
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝরঝর বরষার মতো—
ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তার শুনি অবিরত।
সেই-সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারি দিকে করি স্তূপাকার,
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণনিশার।
বসুন্ধরা
আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে,
কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে,
বিপুল অঞ্চল-তলে। ওগো মা মৃন্ময়ী,
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই;
দিগ্বিদিকে আপনারে দিই বিস্তারিয়া
বসন্তের আনন্দের মতো; বিদারিয়া
এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণ-বন্ধ
সংকীর্ণ প্রাচীর, আপনার নিরানন্দ
অন্ধ কারাগার, হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া,
কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া,
শিহরিয়া, সচকিয়া আলোকে পুলকে
প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে
প্রান্ত হতে প্রান্তভাগে, উত্তরে দক্ষিণে,
পুরবে পশ্চিমে— শৈবালে শাদ্বলে তৃণে
শাখায় বল্কলে পত্রে উঠি সরসিয়া
নিগূঢ় জীবনরসে; যাই পরশিয়া
স্বর্ণশীর্ষে আনমিত শস্যক্ষেত্রতল
অঙ্গুলির আন্দোলনে; নব পুষ্পদল
করি পূর্ণ সংগোপনে সুবর্ণলেখায়
সুধাগন্ধে মধুবিন্দুভারে; নীলিমায়
পরিব্যাপ্ত করি দিয়া মহাসিন্ধুনীর
তীরে তীরে করি নৃত্য স্তব্ধ ধরণীর,
অনন্ত কল্লোলগীতে; উল্লসিত রঙ্গে
ভাষা প্রসারিয়া দিই তরঙ্গে তরঙ্গে
দিক-দিগন্তরে; শুভ্র-উত্তরীয়প্রায়
শৈলশৃঙ্গে বিছাইয়া দিই আপনায়
নিষ্কলঙ্ক নীহারের উত্তুঙ্গ নির্জনে,
নিঃশব্দ নিভৃতে।
যে ইচ্ছা গোপনে মনে
উৎসসম উঠিতেছে অজ্ঞাতে আমার
বহুকাল ধ’রে, হৃদয়ের চারি ধার
ক্রমে পরিপূর্ণ করি বাহিরিতে চাহে
উদ্বেল উদ্দাম মুক্ত উদার প্রবাহে
সিঞ্চিতে তোমায়— ব্যথিত সে বাসনারে
বন্ধমুক্ত করি দিয়া শতলক্ষ ধারে
দেশে দেশে দিকে দিকে পাঠাব কেমনে
অন্তর ভেদিয়া! বসি শুধু গৃহকোণে
লুব্ধ চিত্তে করিতেছি সদা অধ্যয়ন,
দেশে দেশান্তরে কারা করেছে ভ্রমণ
কৌতূহলবশে; আমি তাহাদের সনে
করিতেছি তোমারে বেষ্টন মনে মনে
কল্পনার জালে।
সুদুর্গম দূরদেশ—
পথশূন্য তরুশূন্য প্রান্তর অশেষ,
মহাপিপাসার রঙ্গভূমি; রৌদ্রালোকে
জ্বলন্ত বালুকারাশি সূচি বিঁধে চোখে;
দিগন্তবিস্তৃত যেন ধুলিশয্যা-’পরে
জ্বরাতুরা বসুন্ধরা লুটাইছে পড়ে
তপ্তদেহ, উষ্ণশ্বাস বহ্নিজ্বালাময়,
শুষ্ককণ্ঠ, সঙ্গহীন, নিঃশব্দ, নির্দয়।
কতদিন গৃহপ্রান্তে বসি বাতায়নে
দূরদূরান্তের দৃশ্য আঁকিয়াছি মনে
চাহিয়া সম্মুখে; চারি দিকে শৈলমালা,
মধ্যে নীল সরোবর নিস্তব্ধ নিরালা
স্ফটিকনির্মল স্বচ্ছ; খণ্ড মেঘগণ
মাতৃস্তনপানরত শিশুর মতন
পড়ে আছে শিখর আঁকড়ি; হিমরেখা
নীলগিরিশ্রেণী-’পরে দূরে যায় দেখা
দৃষ্টিরোধ করি, যেন নিশ্চল নিষেধ
উঠিয়াছে সারি সারি স্বর্গ করি ভেদ
যোগমগ্ন ধূর্জটির তপোবন-দ্বারে।
মনে মনে ভ্রমিয়াছি দূর সিন্ধুপারে
মহামেরুদেশে— যেখানে লয়েছে ধরা
অনন্তকুমারীব্রত, হিমবস্ত্রপরা,
নিঃসঙ্গ, নি:স্পৃহ, সর্ব-আভরণহীন;
যেথা দীর্ঘরাত্রিশেষে ফিরে আসে দিন
শব্দশূন্য সংগীতবিহীন; রাত্রি আসে,
ঘুমাবার কেহ নাই, অনন্ত আকাশে
অনিমেষ জেগে থাকে নিদ্রাতন্দ্রাহত
শূন্যশয্যা মৃতপুত্রা জননীর মতো।
নূতন দেশের নাম যত পাঠ করি,
বিচিত্র বর্ণনা শুনি, চিত্ত অগ্রসরি
সমস্ত স্পর্শিতে চাহে— সমুদ্রের তটে
ছোটো ছোটো নীলবর্ণ পর্বতসংকটে
একখানি গ্রাম, তীরে শুকাইছে জাল,
জলে ভাসিতেছে তরী, উড়িতেছে পাল,
জেলে ধরিতেছে মাছ, গিরিমধ্যপথে
সংকীর্ণ নদীটি চলি আসে কোনোমতে
আঁকিয়া বাঁকিয়া; ইচ্ছা করে, সে নিভৃত
গিরিক্রোড়ে সুখাসীন ঊর্মিমুখরিত
লোকনীড়খানি হৃদয়ে বেষ্টিয়া ধরি
বাহুপাশে। ইচ্ছা করে, আপনার করি
যেখানে যা-কিছু আছে; নদীস্রোতোনীরে
আপনারে গলাইয়া দুই তীরে তীরে
নব নব লোকালয়ে করে যাই দান
পিপাসার জল, গেয়ে যাই কলগান
দিবসে নিশীথে; পৃথিবীর মাঝখানে
উদয়সমুদ্র হতে অস্তসিন্ধু-পানে
প্রসারিয়া আপনারে, তুঙ্গ গিরিরাজি
আপনার সুদুর্গম রহস্যে বিরাজি,
কঠিন পাষাণক্রোড়ে তীব্র হিমবায়ে
মানুষ করিয়া তুলি লুকায়ে লুকায়ে
নব নব জাতি। ইচ্ছা করে মনে মনে,
স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোকসনে
দেশে দেশান্তরে; উষ্ট্রদুগ্ধ করি পান
মরুতে মানুষ হই আরব-সন্তান
দুর্দম স্বাধীন; তিব্বতের গিরিতটে
নির্লিপ্ত প্রস্তরপুরী-মাঝে, বৌদ্ধমঠে
করি বিচরণ। দ্রাক্ষাপায়ী পারসিক
গোলাপকাননবাসী, তাতার নির্ভীক
অশ্বারূঢ়, শিষ্টাচারী সতেজ জাপান,
প্রবীণ প্রাচীন চীন নিশিদিনমান
কর্ম-অনুরত— সকলের ঘরে ঘরে
জন্মলাভ করে লই হেন ইচ্ছা করে।
অরুগ্ন বলিষ্ঠ হিংস্র নগ্ন বর্বরতা—
নাহি কোনো ধর্মাধর্ম, নাহি কোনো প্রথা,
নাহি কোনো বাধাবন্ধ, নাই চিন্তাজ্বর,
নাহি কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, নাই ঘর পর,
উন্মুক্ত জীবনস্রোত বহে দিনরাত
সম্মুখে আঘাত করি সহিয়া আঘাত
অকাতরে; পরিতাপ-জর্জর পরানে
বৃথা ক্ষোভে নাহি চায় অতীতের পানে,
ভবিষ্যৎ নাহি হেরে মিথ্যা দুরাশায়—
বর্তমান-তরঙ্গের চূড়ায় চূড়ায়
নৃত্য করে চলে যায় আবেগে উল্লাসি—
উচ্ছৃঙ্খল সে-জীবন সেও ভালোবাসি;
কত বার ইচ্ছা করে সেই প্রাণঝড়ে
ছুটিয়া চলিয়া যাই পূর্ণপালভরে
লঘু তরী-সম।
হিংস্র ব্যাঘ্র অটবীর
আপন প্রচণ্ড বলে প্রকাণ্ড শরীর
বহিতেছে অবহেলে; দেহ দীপ্তোজ্জ্বল
অরণ্যমেঘের তলে প্রচ্ছন্ন-অনল
বজ্রের মতন, রুদ্র মেঘমন্দ্র স্বরে
পড়ে আসি অতর্কিত শিকারের ‘পরে
বিদ্যুতের বেগে; অনায়াস সে মহিমা,
হিংসাতীব্র সে আনন্দ, সে দৃপ্ত গরিমা,
ইচ্ছা করে একবার লভি তার স্বাদ।
ইচ্ছা করে, বারবার মিটাইতে সাধ
পান করি বিশ্বের সকল পাত্র হতে
আনন্দমদিরাধারা নব নব স্রোতে।
হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমা পানে চেয়ে
কত বার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে
প্রকাণ্ড উল্লাসভরে; ইচ্ছা করিয়াছে—
সবলে আঁকড়ি ধরি এ বক্ষের কাছে
সমুদ্রমেখলাপরা তব কটিদেশ;
প্রভাত-রৌদ্রের মতো অনন্ত অশেষ
ব্যাপ্ত হয়ে দিকে দিকে, অরণ্যে ভূধরে
কম্পমান পল্লবের হিল্লোলের ‘পরে
করি নৃত্য সারাবেলা, করিয়া চুম্বন
প্রত্যেক কুসুমকলি, করি’ আলিঙ্গন
সঘন কোমল শ্যাম তৃণক্ষেত্রগুলি,
প্রত্যেক তরঙ্গ-’পরে সারাদিন দুলি’
আনন্দ-দোলায়। রজনীতে চূপে চূপে
নিঃশব্দ চরণে, বিশ্বব্যাপী নিদ্রারূপে
তোমার সমস্ত পশুপক্ষীর নয়নে
অঙ্গুলি বুলায়ে দিই, শয়নে শয়নে
নীড়ে নীড়ে গৃহে গৃহে গুহায় গুহায়
করিয়া প্রবেশ, বৃহৎ অঞ্চলপ্রায়
আপনারে বিস্তারিয়া ঢাকি বিশ্বভূমি
সুস্নিগ্ধ আঁধারে।
আমার পৃথিবী তুমি
বহু বরষের, তোমার মৃত্তিকাসনে
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ
সবিতৃমণ্ডল, অসংখ্য রজনীদিন
যুগযুগান্তর ধরি আমার মাঝারে
উঠিয়াছে তৃণ তব, পুষ্প ভারে ভারে
ফুটিয়াছে, বর্ষণ করেছে তরুরাজি
পত্রফুলফল গন্ধরেণু। তাই আজি
কোনো দিন আনমনে বসিয়া একাকী
পদ্মাতীরে, সম্মুখে মেলিয়া মুগ্ধ আঁখি
সর্ব অঙ্গে সর্ব মনে অনুভব করি—
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে কেমনে শিহরি
উঠিতেছে তৃণাঙ্কুর, তোমার অন্তরে
কী জীবনরসধারা অহর্নিশি ধরে
করিতেছে সঞ্চরণ, কুসুমমুকুল
কী অন্ধ আনন্দভরে ফুটিয়া আকুল
সুন্দর বৃন্তের মুখে, নব রৌদ্রালোকে
তরুলতাতৃণগুল্ম কী গূঢ় পুলকে
কী মূঢ় প্রমোদরসে উঠে হরষিয়া—
মাতৃস্তনপানশ্রান্ত পরিতৃপ্ত-হিয়া
সুখস্বপ্নহাস্যমুখ শিশুর মতন।
তাই আজি কোনো দিন— শরৎ-কিরণ
পড়ে যবে পক্কশীর্ষ স্বর্ণক্ষেত্র-’পরে,
নারিকেলদলগুলি কাঁপে বায়ুভরে
আলোকে ঝিকিয়া, জাগে মহাব্যাকুলতা—
মনে পড়ে বুঝি সেই দিবসের কথা
মন যবে ছিল মোর সর্বব্যাপী হয়ে
জলে স্থলে, অরণ্যের পল্লবনিলয়ে,
আকাশের নীলিমায়। ডাকে যেন মোরে
অব্যক্ত আহ্বানরবে শত বার করে
সমস্ত ভুবন; সে বিচিত্র সে বৃহৎ
খেলাঘর হতে, মিশ্রিত মর্মরবৎ
শুনিবারে পাই যেন চিরদিনকার
সঙ্গীদের লক্ষবিধ আনন্দ-খেলার
পরিচিত রব। সেথায় ফিরায়ে লহ
মোরে আরবার; দূর করো সে বিরহ
যে বিরহ থেকে থেকে জেগে ওঠে মনে
হেরি যবে সম্মুখেতে সন্ধ্যার কিরণে
বিশাল প্রান্তর, যবে ফিরে গাভীগুলি
দূর গোষ্ঠে—মাঠপথে উড়াইয়া ধূলি,
তরুঘেরা গ্রাম হতে উঠে ধূমলেখা
সন্ধ্যাকাশে; যবে চন্দ্র দূরে দেয় দেখা
শ্রান্ত পথিকের মতো অতি ধীরে ধীরে
নদীপ্রান্তে জনশূন্য বালুকার তীরে,
মনে হয় আপনারে একাকী প্রবাসী
নির্বাসিত, বাহু বাড়াইয়া ধেয়ে আসি
সমস্ত বাহিরখানি লইতে অন্তরে—
এ আকাশ, এ ধরণী, এই নদী-’পরে
শুভ্র শান্ত সুপ্ত জ্যোৎস্নারাশি। কিছু নাহি
পারি পরশিতে, শুধু শূন্যে থাকি চাহি
বিষাদব্যাকুল। আমারে ফিরায়ে লহ
সেই সর্ব-মাঝে, যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মুঞ্জরিছে প্রাণ
শতেক সহস্ররূপে, গুঞ্জরিছে গান
শতলক্ষ সুরে, উচ্ছ্বসি উঠিছে নৃত্য
অসংখ্য ভঙ্গিতে, প্রবাহি যেতেছে চিত্ত
ভাবস্রোতে, ছিদ্রে ছিদ্রে বাজিতেছে বেণু
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি শ্যাম কল্পধেনু,
তোমারে সহস্র দিকে করিছে দোহন
তরুলতা পশুপক্ষী কত অগণন
তৃষিত পরানি যত, আনন্দের রস
কত রূপে হতেছে বর্ষণ, দিক দশ
ধ্বনিছে কল্লোলগীতে। নিখিলের সেই
বিচিত্র আনন্দ যত এক মুহূর্তেই
একত্রে করিব আস্বাদন, এক হয়ে
সকলের সনে। আমার আনন্দ লয়ে
হবে না কি শ্যামতর অরণ্য তোমার,
প্রভাত-আলোক-মাঝে হবে না সঞ্চার
নবীন কিরণকম্প? মোর মুগ্ধ ভাবে
আকাশ ধরণীতল আঁকা হয়ে যাবে
হৃদয়ের রঙে— যা দেখে কবির মনে
জাগিবে কবিতা, প্রেমিকের দু-নয়নে
লাগিবে ভাবের ঘোর, বিহঙ্গের মুখে
সহসা আসিবে গান। সহস্রের সুখে
রঞ্জিত হইয়া আছে সর্বাঙ্গ তোমার
হে বসুধে, জীবস্রোত কত বারম্বার
তোমারে মণ্ডিত করি আপন জীবনে
গিয়েছে ফিরেছে, তোমার মৃত্তিকাসনে
মিশায়েছে অন্তরে প্রেম, গেছে লিখে
কত লেখা, বিছায়েছে কত দিকে দিকে
ব্যাকুল প্রাণের আলিঙ্গন; তারি সনে
আমার সমস্ত প্রেম মিশায়ে যতনে
তোমার অঞ্চলখানি দিব রাঙাইয়া
সজীব বরনে; আমার সকল দিয়া
সাজাব তোমারে। নদীজলে মোর গান
পাবে না কি শুনিবারে কোনো মুগ্ধ কান
নদীকূল হতে? উষালোকে মোর হাসি
পাবে না কি দেখিবারে কোনো মর্তবাসী
নিদ্রা হতে উঠি? আজ শতবর্ষ পরে
এ সুন্দর অরণ্যের পল্লবের স্তরে
কাঁপিবে না আমার পরান? ঘরে ঘরে
কত শত নরনারী চিরকাল ধ’রে
পাতিবে সংসারখেলা, তাহাদের প্রেমে
কিছু কি রব না আমি? আসিব না নেমে
তাদের মুখের ‘পরে হাসির মতন,
তাদের সর্বাঙ্গ-মাঝে সরস যৌবন,
তাদের বসন্তদিনে অকস্মাৎ সুখ,
তাদের মনের কোণে নবীন উন্মুখ
প্রেমের অঙ্কুররূপে; ছেড়ে দিবে তুমি
আমারে কি একেবারে ওগো মাতৃভূমি—
যুগযুগান্তের মহা মৃত্তিকা-বন্ধন
সহসা কি ছিঁড়ে যাবে? করিব গমন
ছাড়ি লক্ষ বরষের স্নিগ্ধ ক্রোড়খানি?
চতুর্দিক হতে মোরে লবে না কি টানি
এই সব তরু লতা গিরি নদী বন,
এই চিরদিবসের সুনীল গগন,
এ জীবনপরিপূর্ণ উদার সমীর,
জাগরণপূর্ণ আলো, সমস্ত প্রাণীর
অন্তরে অন্তরে গাঁথা জীবন-সমাজ?
ফিরিব তোমারে ঘিরি, করিব বিরাজ
তোমার আত্মীয়-মাঝে; কীট পশু পাখি
তরু গুল্ম লতা রূপে বারম্বার ডাকি
আমারে লইবে তব প্রাণতপ্ত বুকে;
যুগে যুগে জন্মে জন্মে স্তন দিয়ে মুখে
মিটাইবে জীবনের শত লক্ষ ক্ষুধা
শত লক্ষ আনন্দের স্তন্যরসসুধা
নিঃশেষে নিবিড় স্নেহে করাইয়া পান।
তার পরে ধরিত্রীর যুবক সন্তান
বাহিরিব জগতের মহাদেশ-মাঝে
অতি দূর দূরান্তরে জ্যোতিষ্কসমাজে
সুদুর্গম পথে। এখনো মিটে নি আশা,
এখনো তোমার স্তন-অমৃত-পিপাসা
মুখেতে রয়েছে লাগি, তোমার আনন
এখনো জাগায় চোখে সুন্দর স্বপন,
এখনো কিছুই তব করি নাই শেষ,
সকলি রহস্যপূর্ণ, নেত্র অনিমেষ
বিস্ময়ের শেষতল খুঁজে নাহি পায়,
এখনো তোমার বুকে আছি শিশুপ্রায়
মুখপানে চেয়ে। জননী, লহ গো মোরে
সঘনবন্ধন তব বাহুযুগে ধ'রে—
আমারে করিয়া লহ তোমার বুকের—
তোমার বিপুল প্রাণ বিচিত্র সুখের
উৎস উঠিতেছে যেথা সে গোপন পুরে
আমারে লইয়া যাও— রাখিয়ো না দূরে।
বিম্ববতী
রূপকথা
সযত্নে সাজিল রানী, বাঁধিল কবরী,
নবঘনস্নিগ্ধবর্ণ নব নীলাম্বরী
পরিল অনেক সাধে। তার পরে ধীরে
গুপ্ত আবরণ খুলি আনিল বাহিরে
মায়াময় কনকদর্পণ। মন্ত্র পড়ি
শুধাইল তারে— কহ মোরে সত্য করি
সর্বশ্রেষ্ঠ রূপসী কে ধরায় বিরাজে।
ফুটিয়া উঠিল ধীরে মুকুরের মাঝে
মধুমাখা হাসি-আঁকা একখানি মুখ,
দেখিয়া বিদারি গেল মহিষীর বুক—
রাজকন্যা বিম্ববতী সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সবাকার চেয়ে।
তার পরদিন রানী প্রবালের হার
পরিল গলায়। খুলি দিল কেশভার
আজানুচুম্বিত। গোলাপি অঞ্চলখানি,
লজ্জার আভাস-সম, বক্ষে দিল টানি।
সুবর্ণমুকুর রাখি কোলের উপরে
শুধাইল মন্ত্র পড়ি— কহ সত্য করে
ধরামাঝে সব চেয়ে কে আজি রূপসী।
দর্পণে উঠিল ফুটে সেই মুখশশী।
কাঁপিয়া কহিল রানী, অগ্নিসম জ্বালা—
পরালেম তারে আমি বিষফুলমালা,
তবু মরিল না জ্বলে সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে!
তার পরদিনে— আবার রুধিল দ্বার
শয়নমন্দিরে। পরিল মুক্তার হার,
ভালে সিন্দূরের টিপ, নয়নে কাজল,
রক্তাম্বর পট্টবাস, সোনার আঁচল।
শুধাইল দর্পণেরে— কহ সত্য করি
ধরাতলে সব চেয়ে কে আজি সুন্দরী।
উজ্জ্বল কনকপটে ফুটিয়া উঠিল
সেই হাসিমাখা মুখ। হিংসায় লুটিল
রানী শয্যার উপরে। কহিল কাঁদিয়া—
বনে পাঠালেম তারে কঠিন বাঁধিয়া,
এখনো সে মরিল না সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সবাকার চেয়ে!
তার পরদিনে— আবার সাজিল সুখে
নব অলংকারে; বিরচিল হাসিমুখে
কবরী নূতন ছাঁদে বাঁকাইয়া গ্রীবা,
পরিল যতন করি নবরৌদ্রবিভা
নব পীতবাস। দর্পণ সম্মুখে ধরে
শুধাইল মন্ত্র পড়ি— সত্য কহ মোরে
ধরামাঝে সব চেয়ে কে আজি রূপসী।
সেই হাসি সেই মুখ উঠিল বিকশি
মোহন মুকুরে। রানী কহিল জ্বলিয়া—
বিষফল খাওয়ালেম তাহারে ছলিয়া,
তবুও সে মরিল না সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে!
তার পরদিনে রানী কনক রতনে
খচিত করিল তনু অনেক যতনে।
দর্পণেরে শুধাইল বহু দর্পভরে—
সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ কার বল্ সত্য করে।
দুইটি সুন্দর মুখ দেখা দিল হাসি—
রাজপুত্র রাজকন্যা দোঁহে পাশাপাশি
বিবাহের বেশে। অঙ্গে অঙ্গে শিরা যত
রানীরে দংশিল যেন বৃশ্চিকের মতো।
চীৎকারি কহিল রানী কর হানি বুকে
মরিতে দেখেছি তারে আপন সম্মুখে
কার প্রেমে বাঁচিল সে সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে!
ঘষিতে লাগিল রানী কনকমুকুর
বালু দিয়ে— প্রতিবিম্ব না হইল দূর।
মসী লেপি দিল তবু ছবি ঢাকিল না।
অগ্নি দিল তবুও তো গলিল না সোনা।
আছাড়ি ফেলিল ভূমে প্রাণপণ বলে,
ভাঙিল না সে মায়া-দর্পণ। ভূমিতলে
চকিতে পড়িল রানী, টুটি গেল প্রাণ—
সর্বাঙ্গে হীরকমণি অগ্নির সমান
লাগিল জ্বলিতে। ভূমে পড়ি তারি পাশে
কনকদর্পণে দুটি হাসিমুখ হাসে।
বিম্ববতী, মহিষীর সতিনের মেয়ে
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে।
বিশ্বনৃত্য
বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
কে বাজাবে সেই বাজনা!
উঠিবে চিত্ত করিয়া নৃত্য ,
বিস্মৃত হবে আপনা ।
টুটিবে বন্ধ মহা আনন্দ ,
নব সংগীতে নূতন ছন্দ ,
হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাবে নবীন বাসনা ।
সঘন অশ্রুমগন হাস্য
জাগিবে তাহার বদনে ।
প্রভাত-অরুণকিরণরশ্মি
ফুটিবে তাহার নয়নে ।
দক্ষিণ করে ধরিয়া যন্ত্র
ঝনন রণন স্বর্ণতন্ত্র ,
কাঁপিয়া উঠিবে মোহন মন্ত্র
নির্মল নীল গগনে ।
হা হা করি সবে উচ্ছল রবে
চঞ্চল কলকলিয়া
চৌদিক হতে উন্মাদ স্রোতে
আসিবে তূর্ণ চলিয়া ।
ছুটিবে সঙ্গে মহাতরঙ্গে
ঘিরিয়া তাঁহারে হরষরঙ্গে
বিঘ্নতরণ চরণভঙ্গে
পথকন্টক দলিয়া ।
দ্যুলোক চাহিয়া সে লোকসিন্ধু
বন্ধনপাশ নাশিবে ,
অসীম পুলকে বিশ্ব-ভূলোকে
অঙ্কে তুলিয়া হাসিবে ।
ঊর্মিলীলায় সূর্যকিরণ
ঠিকরি উঠিবে হিরণবরন ,
বিঘ্ন বিপদ দুঃখ মরণ
ফেনের মতন ভাসিবে ।
ওগো কে বাজায় , বুঝি শোনা যায় ,
মহা রহস্যে রসিয়া ,
চিরকাল ধরে গম্ভীর স্বরে
অম্বর- ' পরে বসিয়া ।
গ্রহমণ্ডল হয়েছে পাগল ,
ফিরিছে নাচিয়া চিরচঞ্চল —
গগনে গগনে জ্যোতি-অঞ্চল
পড়িছে খসিয়া খসিয়া ।
ওগো কে বাজায় কে শুনিতে পায় ,
না জানি কী মহা রাগিণী!
দুলিয়া ফুলিয়া নাচিছে সিন্ধু
সহস্রশির নাগিনী ।
ঘন অরণ্য আনন্দে দুলে —
অনন্ত নভে শত বাহু তুলে ,
কী গাহিতে গিয়ে কথা যায় ভুলে ,
মর্মরে দিনযামিনী ।
নির্ঝর ঝরে উচ্ছ্বাসভরে
বন্ধুর শিলা-সরণে ।
ছন্দে ছন্দে সুন্দর গতি
পাষাণহৃদয়-হরণে ।
কোমল কণ্ঠে কুল্ কুল্ সুর
ফুটে অবিরল তরল মধুর ,
সদাশিঞ্জিত মানিকনূপুর
বাঁধা চঞ্চল চরণে ।
নাচে ছয় ঋতু , না মানে বিরাম ,
বাহুতে বাহুতে ধরিয়া
শ্যামল স্বর্ণ বিবিধ বর্ণ
নব নব বাস পরিয়া ।
চরণ ফেলিতে কত বনফুল
ফুটে ফুটে টুটে হইয়া আকুল ,
উঠে ধরণীর হৃদয় বিপুল
হাসি-ক্রন্দনে ভরিয়া ।
পশু-বিহঙ্গ কীটপতঙ্গ
জীবনের ধারা ছুটিছে ।
কী মহা খেলায় মরণবেলায়
তরঙ্গ তার টুটিছে ।
কোনোখানে আলো কোনোখানে ছায়া ,
জেগে জেগে ওঠে নব নব কায়া ,
চেতনাপূর্ণ অদ্ভুত মায়া
বুদ্বুদ সম ফুটিছে ।
ওই কে বাজায় দিবস-নিশায়
বসি অন্তর-আসনে ,
কালের যন্ত্রে বিচিত্র সুর —
কেহ শোনে কেহ না শোনে ।
অর্থ কী তার ভাবিয়া না পাই ,
কত গুণী জ্ঞানী চিন্তিছে তাই ,
মহান মানব-মানস সদাই
উঠে পড়ে তারি শাসনে ।
শুধু হেথা কেন আনন্দ নাই ,
কেন আছে সবে নীরবে ?
তারকা না দেখি পশ্চিমাকাশে ,
প্রভাত না দেখি পুরবে ।
শুধু চারি দিকে প্রাচীন পাষাণ
জগৎ-ব্যাপ্ত সমাধিসমান
গ্রাসিয়া রেখেছে অযুত পরান ,
রয়েছে অটল গরবে ।
সংসারস্রোত জাহ্নবীসম
বহু দূরে গেছে সরিয়া ।
এ শুধু ঊষর বালুকাধূসর
মরুরূপে আছে মরিয়া ।
নাহি কোনো গতি , নাহি কোনো গান ,
নাহি কোনো কাজ , নাহি কোনো প্রাণ ,
বসে আছে এক মহানির্বাণ ,
আঁধার-মুকুট পরিয়া ।
হৃদয় আমার ক্রন্দন করে
মানব-হৃদয়ে মিশিতে —
নিখিলের সাথে মহা রাজপথে
চলিতে দিবস-নিশীথে ।
আজন্মকাল পড়ে আছি মৃত
জড়তার মাঝে হয়ে পরাজিত ,
একটি বিন্দু জীবন-অমৃত
কে গো দিবে এই তৃষিতে ?
জগৎ-মাতানো সংগীততানে
কে দিবে এদের নাচায়ে!
জগতের প্রাণ করাইয়া পান
কে দিবে এদের বাঁচায়ে!
ছিঁড়িয়া ফেলিবে জাতিজালপাশ ,
মুক্ত হৃদয়ে লাগিবে বাতাস ,
ঘুচায়ে ফেলিয়া মিথ্যা তরাস
ভাঙিবে জীর্ণ খাঁচা এ ।
বিপুল গভীর মধুর মন্দ্রে
বাজুক বিশ্ববাজনা!
উঠুক চিত্ত করিয়া নৃত্য
বিস্মৃত হয়ে আপনা ।
টুটুক বন্ধ , মহা আনন্দ ,
নব সংগীতে নূতন ছন্দ —
হৃদয়সাগরে পূর্ণচন্দ্র
জাগাক নবীন বাসনা ।
বৈষ্ণবকবিতা
শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান!
পূর্বরাগ , অনুরাগ , মান-অভিমান ,
অভিসার , প্রেমলীলা , বিরহ-মিলন ,
বৃন্দাবনগাথা — এই প্রণয়-স্বপন
শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে ,
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
শরমে সম্ভ্রমে — এ কি শুধু দেবতার!
এ সংগীতরসধারা নহে মিটাবার
দীন মর্তবাসী এই নরনারীদের
প্রতিরজনীর আর প্রতিদিবসের
তপ্ত প্রেমতৃষা ?
এ গীত-উৎসব-মাঝে
শুধু তিনি আর ভক্ত নির্জনে বিরাজে ;
দাঁড়ায়ে বাহির-দ্বারে মোরা নরনারী
উৎসুক শ্রবণ পাতি শুনি যদি তারি
দুয়েকটি তান — দূর হতে তাই শুনে
তরুণ বসন্তে যদি নবীন ফাল্গুনে
অন্তর পুলকি উঠে , শুনি সেই সুর
সহসা দেখিতে পাই দ্বিগুণ মধুর
আমাদের ধরা — মধুময় হয়ে উঠে
আমাদের বনচ্ছায়ে যে নদীটি ছুটে ,
মোদের কুটির-প্রান্তে যে-কদম্ব ফুটে
বরষার দিনে — সেই প্রেমাতুর তানে
যদি ফিরে চেয়ে দেখি মোর পার্শ্ব-পানে
ধরি মোর বাম বাহু রয়েছে দাঁড়ায়ে
ধরার সঙ্গিনী মোর , হৃদয় বাড়ায়ে
মোর দিকে , বহি নিজ মৌন ভালোবাসা ,
ওই গানে যদি বা সে পায় নিজ ভাষা ,
যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ প্রেমজ্যোতি —
তোমার কি তাঁর , বন্ধু , তাহে কার ক্ষতি ?
সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি ,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি ,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত । হেরি কাহার নয়ান ,
রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে ?
বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে
কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে ,
আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা —
রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
চুরি করি লইয়াছ কার মুখ , কার
আঁখি হতে! আজ তার নাহি অধিকার
সে সংগীতে! তারি নারীহৃদয়-সঞ্চিত
তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত
চিরদিন!
আমাদেরি কুটির-কাননে
ফুটে পুষ্প , কেহ দেয় দেবতা-চরণে ,
কেহ রাখে প্রিয়জন-তরে — তাহে তাঁর
নাহি অসন্তোষ । এই প্রেমগীতি হার
গাঁথা হয় নরনারী-মিলনমেলায় ,
কেহ দেয় তাঁরে , কেহ বঁধুর গলায় ।
দেবতারে যাহা দিতে পারি , দিই তাই
প্রিয়জনে — প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই ,
তাই দিই দেবতারে ; আর পাব কোথা!
দেবতারে প্রিয় করি , প্রিয়েরে দেবতা ।
বৈষ্ণব কবির গাঁথা প্রেম-উপহার
চলিয়াছে নিশিদিন কত ভারে ভার
বৈকুণ্ঠের পথে । মধ্যপথে নরনারী
অক্ষয় সে সুধারাশি করি কাড়াকাড়ি
লইতেছে আপনার প্রিয়গৃহতরে
যথাসাধ্য যে যাহার ; যুগে যুগান্তরে
চিরদিন পৃথিবীতে যুবকযুবতী —
নরনারী এমনি চঞ্চল মতিগতি ।
দুই পক্ষে মিলে একেবারে আত্মহারা
অবোধ অজ্ঞান । সৌন্দর্যের দস্যু তারা
লুটেপুটে নিতে চায় সব । এত গীতি ,
এত ছন্দ , এত ভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি ,
এত মধুরতা দ্বারের সম্মুখ দিয়া
বহে যায় — তাই তারা পড়েছে আসিয়া
সবে মিলি কলরবে সেই সুধাস্রোতে ।
সমুদ্রবাহিনী সেই প্রেমধারা হতে
কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায় তীরে
বিচার না করি কিছু , আপন কুটিরে
আপনার তরে । তুমি মিছে ধর দোষ ,
সে সাধু পণ্ডিত , মিছে করিতেছ রোষ ।
যাঁর ধন তিনি ওই অপার সন্তোষে
অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন বসে ।
ব্যর্থ যৌবন
আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ?
কেন নয়নের জল ঝরিছে বিফল
নয়নে!
এ বেশভূষণ লহ সখী , লহ ,
এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ —
এমন যামিনী কাটিল বিরহ
শয়নে ।
আজি যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ।
আমি বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে
এসেছি ।
বহি বৃথা মনোআশা এত ভালোবাসা
বেসেছি ।
শেষে নিশিশেষে বদন মলিন ,
ক্লান্ত চরণ , মন উদাসীন ,
ফিরিয়া চলেছি কোন্ সুখহীন
ভবনে!
হায় , যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ?
কত উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ
আকাশে!
বনে দুলেছিল ফুল গন্ধব্যাকুল
বাতাসে ।
তরুমর্মর নদীকলতান
কানে লেগেছিল স্বপ্নসমান ,
দূর হতে আসি পশেছিল গান
শ্রবণে ।
আজি সে রজনী যায় , ফিরাইব তায়
কেমনে ।
মনে লেগেছিল হেন , আমারে সে যেন
ডেকেছে ।
যেন চিরযুগ ধরে মোরে মনে করে
রেখেছে ।
সে আনিবে বহি ভরা অনুরাগ ,
যৌবননদী করিবে সজাগ ,
আসিবে নিশীথে , বাঁধিবে সোহাগ-
বাঁধনে ।
আহা , সে রজনী যায় , ফিরাইব তায়
কেমনে ।
ওগো , ভোলা ভালো তবে , কাঁদিয়া কী হবে
মিছে আর ?
যদি যেতে হল হায় , প্রাণ কেন চায়
পিছে আর ?
কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো
রজনীপ্রভাতে বসে রব কত!
এবারের মতো বসন্ত গত
জীবনে ।
হায় যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
কেমনে ।
ভরা ভাদরে
নদী ভরা কূলে কূলে , খেতে ভরা ধান ।
আমি ভাবিতেছি বসে কী গাহিব গান ।
কেতকী জলের ধারে
ফুটিয়াছে ঝোপে ঝাড়ে ,
নিরাকুল ফুলভারে
বকুল-বাগান ।
কানায় কানায় পূর্ণ আমার পরান ।
ঝিলিমিলি করে পাতা , ঝিকিমিকি আলো
আমি ভাবিতেছি কার আঁখিদুটি কালো ।
কদম্ব গাছের সার ,
চিকন পল্লবে তার
গন্ধে-ভরা অন্ধকার
হয়েছে ঘোরালো ।
কারে বলিবারে চাহি কারে বাসি ভালো ।
অম্লান উজ্জ্বল দিন , বৃষ্টি অবসান ।
আমি ভাবিতেছি আজি কী করিব দান ।
মেঘখণ্ড থরে থরে
উদাস বাতাস-ভরে
নানা ঠাঁই ঘুরে মরে
হতাশ-সমান ।
সাধ যায় আপনারে করি শতখান ।
দিবস অবশ যেন হয়েছে আলসে ।
আমি ভাবি আর কেহ কী ভাবিছে বসে ।
তরুশাখে হেলাফেলা
কামিনীফুলের মেলা ,
থেকে থেকে সারাবেলা
পড়ে খ ' সে খ ' সে ।
কী বাঁশি বাজিছে সদা প্রভাতে প্রদোষে ।
পাখির প্রমোদগানে পূর্ণ বনস্থল ।
আমি ভাবিতেছি চোখে কেন আসে জল ।
দোয়েল দুলায়ে শাখা
গাহিছে অমৃতমাখা ,
নিভৃত পাতায় ঢাকা
কপোতযুগল ।
আমারে সকলে মিলে করেছে বিকল ।
No comments:
Post a Comment